খেজুরের উপকারিতা ও অপকারিতা
খেজুরের উপকারিতা ও অপকারিতা জানার আগে চলুন খেজুরের সম্পর্কে কিছু জেনে নেওয়া যাক। সঠিক তথ্য জানা না থাকলেও ৪০০০ খ্রিস্টাব্দের শুরুর দিকে মিশর ও মেসোপটেমিয়ার উর্বর অঞ্চলে খেজুরের চাষ শুরু করা হয়। মধ্যপ্রাচ্যের খাবারের একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে খেজুর। খেজুর গাছ ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের স্থানীয় এবং উষ্ণ, শুষ্ক ও আদ্র জলবায়ুতে সবচেয়ে বেশি লক্ষ্যণীয় এবং সেখানে বেড়ে ওঠার পরিমান বেশি।
এসব গাছ বেড়ে উঠতে সূর্যের পূর্ণ তাপের দরকার হয়। খেজুর গাছের পরিপক্বতায় চার বছরের মতো সময় লাগে, বীজ থেকে জন্মালে ফল উৎপাদন শুরু করতে স্ত্রী খেজুর গাছের ৮ বছরের মতো সময় লেগে যায় কিন্তু শাখা থেকে জন্মানো গাছ দ্রুত ফল উৎপাদন শুরু করে।
এই গাছে শীতের শেষে এবং বসন্তের শুরুতে ফুল ফুটে থাকে। খেজুর গাছ প্রায় ৭৫ ফুট বা ২৩ মিটার লম্বা হয়। নানান দেশে সন্ধ্যাকালীন খাবার হিসেবে, মুসলিম প্রধান দেশে রমজান মাসে বা সারা বছর জুড়ে খেজুরের চাহিদা থাকে।
সারা পৃথিবীতে প্রায় দুশো(২০০) প্রজাতির বেশি খেজুর রয়েছে, খেজুর বিভিন্ন আকারের এবং বিভিন্ন ঘ্রাণের হয়ে থাকে। আকার বা ধরন ভিন্ন হলেও সব খেজুরের পুষ্টিগুন একই। খেজুরে রয়েছে প্রচুর পরিমানে ফাইবার, ভিটামিন ও মিনারেল আরও রয়েছে আয়রন, ভিটামিন বি, পটাশিয়াম,ভিটামিন ,কপার, ম্যাগনেসিয়াম। ধরনের ভিন্নতার কারনে এই সকল উপাদানের বিশেষ করে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ অনেক খেজুরে বেশি থাকে।
জনপ্রিয় খেজুরগুলোর নাম
বাজারে অনেক খেজুর পাওয়া তার মদ্ধে কিছু জনপ্রিয় খেজুর এর নাম উল্লেখহ করা হলঃ
- খুদরি
- সেফরি
- মাবরুম
- খালাস
- মুসকানি
- আজোয়া
- শালাবি
- ওয়াসালি
- সাফাওয়ি
- সিক্কারি
- ওয়ান্নাহ
- ডেইরি
- সাগী
- আনবারা
- বেহরি
এই সব প্রকারভেদের মধ্যে আরবে সবচেয়ে বেশি সহজলভ্য হলো আজোয়া, সাফওয়ি, আনবারা, মাবরুম ও সাগাই এবং বাংলাদেশে মেদজুল, আজোয়া ও সুক্কারি এই তিন রকমের খেজুর বেশ সহজলভ্য ।
সুপ্রাচীন কাল থেকেই খেজুর বিষয়ক নানান গবেষনা হয়ে আসছে, খেজুরের অনেক উপকারিতার কথাও আমাদের অজানা নয়।
আরও পড়ুনঃ পেয়ারা খাওয়ার উপকারিতা
খেজুর খেলে কি হয়
খেজুরে রয়েছে বিশাল পুষ্টি সম্ভার। খেজুর শুকানো ফল হওয়ায় বিভিন্ন কাচা ফল থেকে এর পুষ্টি উপাদান বেশি, যেমনটা আমরা কিসমিস এবং ত্বীন ফলেও দেখতে পাই। খেজুরে বেশিরভাগ ক্যালরি আসে কার্বোহাইড্রেট থেকে। নিচে ১০০ গ্রাম মেডজুল খেজুরের পুষ্টি উপাদানের তালিকা উল্লেখি হলোঃ
- ক্যালোরি: ২৭৭
- শর্করা: ৭৫ গ্রাম
- ফাইবার: ৭ গ্রাম
- প্রোটিন: ২ গ্রাম
- পটাসিয়াম: ১৫% ডিভি
- ম্যাগনেসিয়াম: ১৩% ডিভি
- তামা: ৪০% ডিভি
- ম্যাঙ্গানিজ: ১৩% ডিভি
- আয়রন: ৫% ডিভি
- ভিটামিন বি৬: ১৫% ডিভি
কোন খেজুরে উপকার বেশি
খেজুর একধরনের খাবার ফল যার স্বাদ খুবই মিষ্টি হয়ে থাকে। এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে আয়রন পটাসিয়াম ম্যাগনেসিয়াম ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন বি, ভিটামিন সি, ভিটামিন কে সহ শরীরের প্রতিদিনের ক্যলরির চাহিদা পুরন করতে সক্ষম।
প্রোটিন উপস্থিত- খেজুরে থাকা প্রোটিন মানব শরীরের পেশী গঠনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
ভিটামিন উপস্থিত- খেজুরে বেশ কয়েক প্রকার ভিটামিন বিদ্যমান। বিশেষ করে এই ফলটিতে ভিটামিন b1 b2 b3 এবং b5 উপস্থিত থাকে।খেজুর এমন একটি মাধ্যম যা ভিটামিন এ এবং ভিটামিন সি এর চাহিদা পূরণ করে। খেজুর খাওয়ার ফলে দৃষ্টিশক্তি প্রখর হয় এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায়।
আয়রন উপস্থিতঃ মানবদেহের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান হলো আয়রন। বিশেষ করে নারীদের দেহে আয়রনের প্রচুর দরকার যা পুরুষদের তুলনায় হাজার গুণ বেশি। আয়রনের অভাবে শরীরে রক্তশুন্যতা হয়। শরীরে আয়রন পেতে নিয়মিত খেজুর খাওয়ার বিকল্প নেই। এটি হৃদপিন্ডের কার্য ক্ষমতা বৃদ্ধিতে কাজ করে।
দুর্বল হৃদপিণ্ড ব্যক্তিদের খেজুর একটি আদর্শ খাদ্য। কারণ হৃদপিণ্ডের রোগ প্রতিরোধে প্রতিশেধক হিসেবে কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই কাজ করবে খেজুর।
কোলেস্টরেল ও চর্বিঃ খেজুরে কোনরকমের বাড়তি চর্বি এবং কোলেষ্টরেল থাকে না। যার ফলে আপনি খেজুর খেলে আপনার ওজন বেড়ে যাওয়ার কোন ভয় বা সম্ভাবনামাত্র থাকে না।
ক্যালসিয়াম উপস্থিতঃ খেজুরে পর্যাপ্ত পরিমাণ ক্যালসিয়াম উপস্থিত যা মানবশরীরের হাড় গঠনে সহায়তা ভুমিকা রেখে থাকে।বিশেষ করে খেজুরের ক্যালসিয়াম শিশুদের জন্য খুবই উপকারী যা তাদের দাতের মারি গঠনে বিশেষ ভুমিকা রাখে।
আপনার পরিবারের বাচ্চাদেরকে নিয়মিত খেজুর খাওয়াত পাড়েন।
ফাইবারঃ উপস্থিত খেজুরে প্রচুর পরিমাণে একধরনের ফাইবার থাকে।
আরও পড়ুনঃ কলা খাওয়ার উপকারিতা
খেজুরের উপকারিতা
- খেজুরে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার যা আমাদের পাকস্থলির খাবার হজম করতে দারুন সহায়তা করে।
- খেজুরে প্রচুর পরিমাণে এন্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়তে সাহায্য করে।
- মস্তিষ্কের বিকাশের জন্যে উপকারি।
- নিশ্চিন্তে চিনির বদলে ব্যবহার করা যায়, চিনিকে সাধারণত সাদা বিষ বলা হয় কিন্তু খেজুর মিষ্টি হলেও চিনির মত ক্ষতিকর না।
- ক্ষুদা নিবারণে কার্যকরী।
- খেজুর খেলে শরীরে দ্রুত শক্তির সঞ্চার হয়।
- প্রতি ১০০ গ্রাম খেজুরে ২৭০- ৩১০ ক্যালরি থাকে যা অনায়াসেই আমাদের ক্যালরির ঘাটতি মেটাতে পারে। এমনকি ডায়েটের সময় পর্যাপ্ত ক্যালরি শরীরে থাকা জরুরী যা খুব সহজেই খেজুর দ্বারা পূরণ করা যায়।
- খেজুর বিষয়ক একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে খেজুরে বিটা ডি গ্লুকোন (Beta-D-glucan) নামক একটি যৌগের উপস্থিতি রয়েছে যা শরীরের অভ্যন্তরে টিউমার বিরোধী কার্যক্রমে সাহায্য করে।
- নিয়মিত খেজুর খেলে ক্ষরিকারক না এমন টিউমারও আস্তে আস্ত শরীর থেকে বিলীন হয়ে যায়।
- খেজুরে এন্টিঅক্সিডেন্টের উচ্চ ঘনত্ব র্যাডিকাল ( ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপাদান) এর ক্রিয়াকলাপ কমাতে সাহায্য করে। ফলে ক্যান্সারের সম্ভাবনা কম থাকে।
- ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ কখনও কখনও মারাত্নক আকার ধারন করতে পারে এবং এতে জীবনের ঝুঁকিও বাড়তে পারে।
- খেজুরের মধ্যে শরীরের ইনসুলিনের উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষমতা রয়েছে, এবং এর এমন কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা অন্ত্র থেকে গ্লুকোজ শোষনের হার কমাতে পারে যা ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রনে সাহায্য করে।
- খেজুরের নির্যাস কিডনির অতিরক্ত প্লাজমা (Plasma) এবং ক্রিয়েটিনাইন (Creatinine) কমাতেও সাহায্য করে যা কিডনির সার্বিক স্বাস্থ্যের জন্যে ভালো।
- বন্ধ্যাত্ব কেবল নারীদের মাঝেই দেখা যায় এই ধারণাটি বেশ ভুল, পুরুষদের মাঝেও এই একই সমস্যা দেখা যায়। নিয়মিত খেজুর খেলে পুরুষদের মধ্যে বন্ধ্যাত্বের হার কমাতে সাহায্য করবে।
- হাড়ের সঠিক গঠনের জন্যে খেজুর সাহায্য করে।
- যেহেতু খেজুরে প্রচুর পরিমাণে আয়রন রয়েছে তাই খেজুর খেলে অতিরিক্ত চুল পরা রোধ হয়।
- ভিটামিন এ এর অভাবে রাত কানা রোগ হতে পারে আর খেজুরে রয়েছে ভিটামিন এ যা রাত কানা রোগ রোধে সহায়তা করে।
- কিছু গবেষনায় দেখা গেছে যে আয়রন সাপ্লিমেন্টের সাথে নিয়ম করে খেজুর খেলে রক্তশূণ্যতা বা এনেমিয়া হওয়া থেকে বাঁচা যায় এবং রোধ করা সম্ভব।
- প্রসবী মায়ের সন্তান প্রাকৃতিকভাবে জন্মাতেও খেজুর সাহায্য করে। কোন রকম অপারেশন বা সিজার ছাড়াই সন্তানের সুস্থ প্রসব সাধারনভাবে সম্ভব।
- প্রতিদিন দুইটি খেজুর আমাদেরকে কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে রক্ষা করতে পারে।
খেজুরের অপকারিতা
খেজুরের অসংখ্য উপকারিতা আছে, এটা যেমন সত্য তেমন কিছু কিছু ক্ষেত্রেখেজুর গ্রহনে সতর্ক হওয়া উচিত।
- অনেকেরই খেজুরে এলার্জির সমস্যা থাকে, সেই ক্ষেত্রে খেজুর এড়িয়ে চলা উত্তম।
- খেজুর অতিরিক্ত মিষ্টি হওয়ায় রক্তে সুগারের মাত্রা খুব দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে যা খুবই মারাত্নক সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।
- অতিরিক্ত ক্যালরি থাকে খেজুরে যা ওজন বৃদ্ধি করতে পাড়ে। দুইটি খেজুরে ১১০ পরিমাণ ক্যালরি থাকে।
আরও পড়ুনঃ কাঁচা ছোলা খাওয়ার উপকারিতা
উপসংহার
আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, খেজুর নিঃসন্দেহে একটি উপকারি খাবার, ক্যালরির সহজ উৎস হিসেবে খেজুর সহজলভ্য। এত সহজে ভিটামিনের সহজ উৎস খুব কম খাবারেই পাওয়া যায়। চেষ্টা করা উচিত প্রতিদিন ৩-৪ টি খেজুর খাওয়া উচিত, তবে যাদের সুগার লেভেল বেশী বা ডায়েবেটিস রয়েছে তাদের খেজুর বেশি পরিমাণে খাওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত। আজ আমরা খেজুরের উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে জানলাম। আপনি যদি এই সম্পর্কের না জেনে থাকেন তাহলে অবশ্যই ভাল হবে জেনে নিন।
আপনার সুস্থতা কামনা করে আজকের মত এখানেই শেষ করছি ধন্যবাদ।
আরও পড়ুন-