তাহাজ্জুদ নামাজের বাংলা নিয়ত ও সহিহ হাদিসসমূহ

তাহাজ্জুদ নামাজের বাংলা নিয়ত

তাহাজ্জুদ একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ফজিলতপূর্ণ ইবাদত। যারা বিনা হিসাবে জান্নাতে যেতে পারবেন, তাদের মধ্যে এক শ্রেণীর মানুষ হবে এমন, যারা তাহাজ্জুদের নামাজ যত্নের সঙ্গে আদায় করতেন। মুলত এটি নফল ইবাদত। তবে নফলের মধ্যে এটি উত্তম ইবাদত। তাহাজ্জুদ নামাজের বাংলা নিয়ত নফল ইবাদতকে নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শ্রেষ্ঠ নফল হিসেবে উল্লেখ করেছেন।  

আবু হোরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে বলতে শুনেছি। আফজালুস সালাতি বাদাল মাফরুদাতি সালাতুল লাইলি’ অর্থাৎ ফরজ নামাজের পর সবচেয়ে উত্তম নামাজ হলো তাহাজ্জুদের নামাজ।” – (মুসলিম, তিরমিজি, নাসাঈ)

তিনি নিয়মিত তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করতেন এবং সাহাবীদেরও নামাজ আদায়ে উৎসাহিত করতেন। আল্লাহ্‌ তা’আলা কুরআন মাজিদের বিভিন্ন সুরায় তাহাজ্জুদ নামাজের বাংলা নিয়ত এর প্রতি তাগিদ দিয়েছেন। আজকের আর্টিকেলে তাহাজ্জুদ নামাজের বাংলা নিয়ত সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করা হল।

তাহাজ্জুদ নামাজ কি

তাহাজ্জুদ অর্থ ঘুম থেকে জাগা। এই রাতের নামাজ একটি নফল ইবাদত, ফরজ নামাজের পরে সুন্নত ও নফল নামাজের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মর্যাদা ও গুরুত্বপূর্ণ। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হবার পূর্বে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর উপর তাহাজ্জুদ নামাজ বাধ্যতামুলক ছিল।

তাহাজ্জুদ নামাজের বাংলা নিয়ত Tahajjud namaz niyat
তাহাজ্জুদ নামাজের বাংলা নিয়ত

তবে উম্মতদের জন্য এই নামাজ সুন্নতে গায়রে মুয়াক্কাদা অর্থাৎ এই নামাজ পড়লে অশেষ সওয়াব হবে। কিন্তু না পড়লে কোন গুনাহ হবে না। 

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তোমরা তাহাজ্জুদের নামাযকে আকড়ে ধরো, কেননা, তা তোমাদের পূর্ববর্তী বুযুর্গদের সিফাত, তোমাদের পালনকর্তার নৈকট্য লাভের মাধ্যম, পাপসমূহ মোচনকারী এবং গুনাহ থেকে বাঁধাদানকারী। (সুনানে তিরমিযী, হাদীস: ৩৬১৯)

হযরত আবু উমামা বাহিলী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

،عليكم بقيام الليل، فانه دأب الصالحين قبلكم، وهو قربة لكم الى ربكم ومكفره للسيئات ومنهاة للاثم

তোমরা কিয়ামুল লায়ল (তাহাজ্জুদের) বিষয়ে যত্নবান হও। কেননা, তা ছিল তোমাদের পূর্ববর্তী পুণ্যবান মানুষের অভ্যাস। আর তা হচ্ছে তোমাদের পালনকর্তার নৈকট্য লাভের উপায়, গুনাহ মোচনকারী এবং মন্দ কাজ থেকে নিবৃত্তকারী।’ (বায়হাকী: ২/৫০২)

উন্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত-

ان نبي الله كان يقوم من الليل حتى تتفطر قدماه. فقالت عائشة: لم تصنع هذا يا رسول الله صلى الله عليه وسلم وقد غفر الله لك ما تقدم وما تأخر؟ قال أفلا أحب أن أكون عبدا شكورا

“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে এত দীর্ঘ সময় নামাযে দণ্ডায়মান থাকতেন যে, তার কদম মোবারক ফুলে যেত। এ অবস্থা দেখে উন্মুল মুমিনীন বললেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! এত পরিশ্রম আপনি কেন করছেন অথচ আল্লাহ আপনার বিগত-আগত সকল কিছুই ক্ষমা করে দিয়েছেন?’ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তবে কি আমি কৃতজ্ঞ বান্দা হওয়া পছন্দ করব না’?” (সহীহ বুখারী: ২/৭১৬)

তাহাজ্জুদ নামাজের বাংলা নিয়ত ও উপযুক্ত সময় হল রাতের শেষ অংশ। তবে ঘুম থেকে জাগার সম্ভাবনা না থাকলে এশার নামাজের পরেও এই নামাজ পড়া যায়। 

তাহাজ্জুদের নামাজ পরার নিয়ম

তাহাজ্জুদের নামাজ মুলত দুই রাকাত, ৪ রাকাত বা ৮ রাকাত করেও পড়া যায়। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) দুই রাকাত করে তাহাজ্জুদের নামাজ পরতেন। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি এশার পর দুই বা ততোধিক রাকাত নামাজ পড়ে নেয়, সে হবে তাহাজ্জুদের ফজিলতের অধিকারী।”

যেকোনো সূরা দিয়ে তাহাজ্জুদ নামাজের বাংলা নিয়ত করে পড়া যায়। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) যথাসম্ভব লম্বা কেরাত, লম্বা রুকু ও সেজদা সহকারে একান্ত নির্দিষ্ট মনে তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করতেন। তাই লম্বা কেরাতে নামাজ পড়া উত্তম। 

নিয়ম – 

১। তাহাজ্জুদ নামাজের বাংলা নিয়ত করে পরার জন্য নামাজের সকল শর্ত পূরণ করে নামাজের জন্য দাঁড়াতে হবে।

২। তাহাজ্জুদ নামাজের বাংলা নিয়ত পড়ে তাকবির তাহরিমা আল্লাহু আকবর বলে নিয়ত বাঁধতে হবে।

৩। এরপর ছানা পড়ুন

৪। আউজুবিল্লাহ-বিসমিল্লাহ পড়ে সূরা ফাতিহা পড়ুন

৫। সূরা ফাতিহা পড়া শেষে অন্য একটি সূরা কেরাত পড়ুন

৬। এরপর রুকু – সেজদাহ যথাযথ নিয়মে করুন।

৭। এভাবে দ্বিতীয় রাকাত শেষ করে তাশাহহুদ, দরূদ ও দোয়া মাছুরা পড়ে সালাম ফেরানোর মাধ্যমে নামায শেষ করুন।

তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত 

নিয়ত অর্থ মনের ইচ্ছা। আপনি যে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করবেন তা মনে মনে সংকল্প করুন। এর সাথে কত রাকাত পরবেন তাও নির্ধারণ করুন। 

তাহাজ্জুদ নামাজের বাংলা নিয়ত 

তাহাজ্জুদ নামাজের বাংলা নিয়ত ” আমি কেবলা মুখি হয়ে দুই রাকাত তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করতেছি” 

তাহাজ্জুদ নামাজের আরবি নিয়ত 

আরবিতে কোন নামাজের নিয়ত করা জরুরী নয়। আরবিতে অর্থ জানা না থাকলে আরবিতে নিয়ত না করাই ভাল। এক্ষেত্রে বাংলায় নিয়ত করতে পারেন। 

نَوَيْتُ اَنْ اُصَلِّىَ رَكَعَتِى التَّهَجُّدِ – اَللهُ اَكْبَر

অর্থ : নাওয়াইতু আন উসাল্লিয়া লিল্লাহি তাআলা রাকাতাই ছালাতিত তাহাজ্জুদী সুন্নাতু রাসুলিল্লাহি তাআলা মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কাবাতিশ শারীফাতি আল্লাহু আকবর ।

বাংলায়: আমি আল্লাহর ওয়াস্তে কেবলার দিকে মুখ করিয়া তাহাজ্জুদের দু-রাকাত সুন্নাত নামাজের নিয়ত করিলাম।

বাংলা উচ্চারণ – নাওয়াইতু আন অুসাল্লি রাক্’আতাই তাহাজ্জুদি

তাহাজ্জুদ নামাজের ওয়াক্ত 

এশার নামাজের পরে সুবহে সাদিকের আগপর্যন্ত তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া যায়। কুরআনে তাহাজ্জুদের নামাজ সম্পর্কে যে তাকীদ দেয়া হয়েছে তার অর্থ এই যে, রাতের কিছু অংশ ঘুমিয়ে থাকার পরে উঠে নামাজ পড়া। নবী (সাঃ) কখনো মধ্য রাতে, কখনো তার কিছু আগে বা পরে ঘুম থেকে উঠতেন এবং আসমানের দিকে তাকিয়ে সূরা আলে ইমরানের শেষ কয়েকটি আয়াত পরতেন। তারপর ওযু করে নামাজ পরতেন। 

হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত-

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللهِ ﷺ قَالَ يَنْزِلُ رَبُّنَا تَبَارَكَ وَتَعَالَى كُلَّ لَيْلَةٍ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا حِينَ يَبْقَى ثُلُثُ اللَّيْلِ الآخِرُ فَيَقُولُ مَنْ يَدْعُونِى فَأَسْتَجِيبَ لَهُ وَمَنْ يَسْأَلُنِى فَأُعْطِيَهُ وَمَنْ يَسْتَغْفِرُنِى فَأَغْفِرَ لَهُ

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “আমাদের পরওয়ার-দেগার প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশে দুনিয়ার আসমানে অবতীর্ণ হন এবং বলেন,’কোনো দুআকারী আছে কি? আমি তার দুআ কবুল করব। কোনো প্রার্থনাকারীআছে কি? আমি তার প্রার্থিত বস্তু দান করব। কোনো ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করব’।” (তিরমিযী শরীফের বর্ণনায় একথাও আছে যে, এই আহ্বান সুবহে সাদিক পর্যন্ত চলতে থাকে।) (সহীহ বুখারী: ১/১৫৩)। 

তাহাজ্জুদ নামাজের রাকাত সংখ্যা 

উন্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত:

ما كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يزيد في رمضان ولا في غيره على إحدى عشرة ركعة يصلي اربعا، فلا تسأل عن حسنهن وطولهن، ثم يصلي اربعا، فلا تسأل عن حسنهن وطولهن ثم يصلي ثلاثا

‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানে ও রমযানের বাইরে বারো রাকাআতের বেশি পড়তেন না। চার রাকাআত নামায পড়তেন, যার দীর্ঘতা ও সৌন্দর্য সম্পর্কে কী বলব! এরপর চার রাকাআত পড়তেন, যার দীর্ঘতা ও সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করা যায় না! এরপর তিন রাকাআত পড়তেন।’ (সহীহ মুসলিম: ১/২৫৪)

তাহাজ্জুদ নামাজের দোয়া 

প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গভীর রাতে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায়ের জন্য ওঠে কুরআনের এ আয়াতসহ সুরা আল-ইমরানের শেষ পর্যন্ত পড়তেন। – (বুখারি, মুসলিম ও মিশকাত)

رَبَّنَا مَا خَلَقْتَ هَذا بَاطِلاً سُبْحَانَكَ فَقِنَا عَذَابَ النَّارِ – رَبَّنَا إِنَّكَ مَن تُدْخِلِ النَّارَ فَقَدْ أَخْزَيْتَهُ وَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ أَنصَارٍ – رَّبَّنَا إِنَّنَا سَمِعْنَا مُنَادِيًا يُنَادِي لِلإِيمَانِ أَنْ آمِنُواْ بِرَبِّكُمْ فَآمَنَّا رَبَّنَا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا وَكَفِّرْ عَنَّا سَيِّئَاتِنَا وَتَوَفَّنَا مَعَ الأبْرَارِ

উচ্চারণ: রাব্বানা মা খালাক্বতা হাজা বাত্বিলান, সুবহানাকা ফাক্বিনা ‘আজাবান্নার। রাব্বানা ইন্নাকা মাং তুদখিলিন্নারা ফাক্বাদ্ আখঝাইতাহু, ওয়া মা লিজজ্বালিমিনা মিন্ আংছার। রাব্বানা ইন্নানা সামি’না মুনাদিআই ইউনাদি লিল ইমানি আন আমিনু বিরাব্বিকুম ফাআমান্না; রাব্বানা ফাগফিরলানা জুনুবানা ওয়া কাফ্‌ফির আন্না সাইয়্যেআতিনা ওয়া তাওয়াফ্ফানা মাআ’ল আবরার।’

অর্থ: ‘হে আমাদের প্রতিপালক! এসব তুমি অনর্থক সৃষ্টি করনি। পবিত্রতা তোমারই জন্য। আমাদেরকে তুমি জাহানড়বামের শাস্তি থেকে বাঁচাও। হে প্রতিপালক! নিশ্চয়ই তুমি যাকে জাহানড়বামে নিক্ষেপ কর তাকে অপমানিত কর। আর যালিমদের জন্য কোন সাহায্যকারী নেই। হে আমাদের প্রভু! আমরা ঈমান আনার জন্য একজন আহবানকারীকে আহবান করতে শুনে ঈমান এনেছি। হে আমাদের পালনকর্তা! তুমি আমাদের সকল গোনাহ মাফ করে দাও। আমাদের সকল দোষ-ত্রুটি দূর করে দাও। আর নেক লোকদের সঙ্গে আমাদের মৃত্যু দাও।’

হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাতে তাহাজ্জুদের উদ্দেশে যখন দাঁড়াতেন, তখন এ দোয়া পড়তেন:-

اللَّهُمَّ لَكَ الْحَمْدُ أَنْتَ قَيِّمُ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضِ وَمَنْ فِيهِنَّ وَلَكَ الْحَمْدُ، لَكَ مُلْكُ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضِ وَمَنْ فِيهِنَّ،
وَلَكَ الْحَمْدُ أَنْتَ نُورُ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضِ، وَلَكَ الْحَمْدُ أَنْتَ الْحَقُّ، وَوَعْدُكَ الْحَقُّ، وَلِقَاؤُكَ حَقٌّ، وَقَوْلُكَ حَقٌّ، وَالْجَنَّةُ حَقٌّ، وَالنَّارُ حَقٌّ،
وَالنَّبِيُّونَ حَقٌّ، وَمُحَمَّدٌ صلى الله عليه وسلم حَقٌّ، وَالسَّاعَةُ حَقٌّ، اللَّهُمَّ لَكَ أَسْلَمْتُ، وَبِكَ آمَنْتُ وَعَلَيْكَ تَوَكَّلْتُ، وَإِلَيْكَ أَنَبْتُ، وَبِكَ خَاصَمْتُ، وَإِلَيْكَ حَاكَمْتُ، فَاغْفِرْ لِي مَا قَدَّمْتُ وَمَا أَخَّرْتُ، وَمَا أَسْرَرْتُ وَمَا أَعْلَنْتُ، أَنْتَ الْمُقَدِّمُ وَأَنْتَ الْمُؤَخِّرُ، لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ ـ أَوْ لاَ إِلَهَ غَيْرُكَ

উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা লাকাল হামদু আংতা কায়্যিমুস সামাওয়অতি ওয়াল আরদি ওয়া মান ফিহিন্না ওয়া লাকালহামদু। লাকা মুলকুস সামাওয়অতি ওয়াল আরদি ওয়া মান ফিহিন্না। ওয়া লাকাল হামদু আংতা নুরুস সামাওয়াতি ওয়াল আরদ। ওয়া লাকাল হামদু আংতাল হাক্কু। ওয়া ওয়া’দুকাল হাক্কু। ওয়া লিক্বাউকা হাক্কু। ওয়াল ঝান্নাতু হাক্কু। ওয়ান নারু হাক্কু। ওয়ান নাবিয়্যুনা হাক্কু। ওয়া মুহাম্মাদুন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা হাক্কু। ওয়াস সাআতু হাক্কু। আল্লাহুম্মা লাকা আসলামতু। ওয়াবিকা আমাংতু ওয়া আলাইকা তাওয়াক্কালতু। ওয়া ইলাইকা আনাবতু। ওয়া বিকা খাসামতু। ওয়া ইলাইকা হাকামতু। ফাগফিরলি মা কাদ্দামতু ওয়া মা আখ্খারতু। ওয়া মা আসরারতু ওয়া মা আ’লাংতু। আংতাল মুকাদ্দিমু ওয়া আংতাল মুআখ্খিরু। লা ইলাহা ইল্লা আংতা। লা ইলাহা গাইরুকা।’ (বুখারি)

অর্থ: ‘হে আল্লাহ! সব প্রশংসা আপনারই, আপনিই আসমান-জমিন ও উভয়ের মাঝে বিদ্যমান সব কিছুর নিয়ামক এবং আপনারই জন্য সব প্রশংসা। আসমান-জমিন এবং এর মাঝে বিদ্যমান সব কিছুর কর্তৃত্ব আপনারই। আপনারই জন্য সব প্রশংসা। আপনি আসমান-জমিনের নুর। আপনারই জন্য সব প্রশংসা। আপনি আসমান-জমিনের মালিক, আপনারই জন্য সব প্রশংসা। আপনিই চির সত্য। আপনার ওয়াদা চির সত্য। (পরকালে) আপনার সাক্ষাৎ সত্য। আপনার বাণী সত্য। আপনার জান্নাত সত্য। আপনার জাহান্নাম সত্য। আপনার (প্রেরিত) নবিগণ সত্য। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম সত্য, কেয়ামত সত্য।

হে আল্লাহ! আপনার কাছেই আমি আত্মসমর্পণ করলাম, আপনার ওপর ঈমান আনলাম, আপনার ওপরই ভরসা করলাম, আপনার দিকেই রুজু করলাম, আপনার (সন্তুষ্টির জন্যই) শত্রুতায় লিপ্ত হলাম, আপনাকেই বিচারক মেনে নিলাম। তাই আপনি আমার আগের-পরের প্রকাশ্য ও গোপন সব পাপ/অপরাধ ক্ষমা করুন। আপনিই শুরু এবং আপনিই শেষ মালিক। আপনি ব্যতিত সত্য কোনো প্রকৃত ইলাহ নেই অথবা আপনি ব্যতিত (ইবাদতের উপযুক্ত) অন্য কেউ নেই।’

তাহাজ্জুদ নামাজের ফজিলত 

রাত জেগে দাঁড়িয়ে নামায করা মুমিনের মর্যাদার সিঁড়ি। এটি জান্নাতে যাওয়ার একটি উপায় এবং সফলতার চাবিকাঠি। আল্লাহর প্রিয় হওয়ার অন্যতম পথ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনও তাহাজ্জুদ নামায ছেড়ে দেননি। যদি কোনো কারণে ছুটে যেত, তবে কাযা করতেন। নিজে তাহাজ্জুদ আদায় করতেন এবং সাহাবাদেরও উৎসাহিত করতেন।

পবিত্র কুরআনে তাহাজ্জুদ নামাজের বাংলা নিয়ত সম্পর্কে বলা হয়েছে,

“তারা রাতের সামান্য অংশই নিদ্রায় অতিবাহিত করে এবং রাতের শেষ প্রহরে তারা ক্ষমা প্রার্থনা করে। সুরা আয- যারিয়াত, আয়াত ১৭-১৮”

সূরা আল ফুরকান-এর ৬৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে “আল্লাহর প্রিয় বান্দা তারা, যারা তাদের রবের দরবারে সিজদা করে এবং দাঁড়িয়ে থেকেই রাত কাটিয়ে দেয়।”

“তারা ছিল কঠিন পরীক্ষায় পরম ধৈর্যশীল, অটল-অবিচল, সত্যের অনুসারী, পরম অনুগত। আল্লাহর পথে ধন-সম্পদ উৎসর্গকারী এবং রাতের শেষ প্রহরে আল্লাহর কাছে ভুলত্রুটির ক্ষমাপ্রার্থী”। (সূরা আল ইমরান : আয়াত ১৭)

রাসুল (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি রাত্রে ঘুম থেকে জেগে তাহাজ্জুদের নামায পড়ে এবং সে তার স্ত্রীকেও ঘুম থেকে জাগিয়ে নামায পড়ায় এমনকি সে যদি জেগে না উঠে, তবে তার মুখে খানিকটা পানি ছিটিয়ে দেয় তাহলে তার প্রতি আল্লাহ রহমত বর্ষণ করে থাকেন। অনুরুপ কোন মহিলা যদি রাত্রিকালে জাগ্রত হয়ে তাহাজ্জুদ নামায পড়ে এবং সে তার স্বামীকে নামাযের জন্য জাগায় এমনকি স্বামী না জাগলে স্ত্রী তার মুখে পানি ছিটিয়ে তার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দেয় তাহলে তার প্রতিও আল্লাহর রহমত বর্ষিত হতে থাকে। (আবু দাউদ, নাসায়ী, মেশকাত ১০৯ পৃঃ)

রাসুল (সাঃ) বলেন, আল্লাহর নিকট অতি প্রিয় নামায দাউদ (আঃ) এর নামায। তিনি অর্ধেক রাত ঘুমাতেন, রাতেন তৃতীয় ভাগে নামাযে দাঁড়াতেন আর ৬ষ্ঠ ভাগে আবার ঘুমাতেন। (বুখারী, মুসলিম, মেশকাত ১০৯ পৃঃ)

মুমিনের মর্যাদার সোপান 

হজরত জিব্রাইল (আঃ) আল্লাহ্‌র হুকুমে নবীজির কাছে আসতেন। নবীজিকে কিছু উপদেশ শোনাতেন আবার চলে যেতেন। একদিন তিনি উম্মতদের মর্যাদার ব্যাপারে বললেন – 

يَا مُحَمّدُ! شَرَفُ الْمُؤْمِنِ قِيَامُ اللّيْلِ وَعِزّهُ اسْتِغْنَاؤُهُ عَنِ النّاسِ.

قال المنذري في الترغيب والترهيب ১/ ৩৩৩: إسناده حسن، وأشار إلى ثبوته الهيثمي في مجمع الزوائد، ২/ ২৫৩

হে মুহাম্মাদ! মুমিনের মর্যাদা কিয়ামুল লাইল- রাতে দাঁড়িয়ে নামায আদায় ও বিভিন্ন বন্দেগীর মধ্যে, আর তাঁর সম্মান মানুষ থেকে অমুখাপেক্ষিতার মধ্যে। -মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ৭৯২১; আলমুজামুল আওসাত, তবারানী, হাদীস ৪২৭৮

ফরজ নামাজের পরেই যার স্থান 

ফরয নামাজের পরেই যে নামাজ আল্লাহ্‌র কাছে প্রিয় তা হল তাহাজ্জুদ। 

أَفْضَلُ الصِّيَامِ بَعْدَ رَمَضَانَ شَهْرُ اللهِ الْمُحَرّمُ، وَأَفْضَلُ الصّلاَةِ بَعْدَ الْفَرِيضَةِ، صَلاَةُ اللّيْلِ.

রমযানের পর রোযা রাখার উত্তম সময় মুহাররম মাস আর ফরয নামাযের পর উত্তম নামায রাতের নামায, অর্থাৎ তাহাজ্জুদ। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৭২৫

যে আমল নবীজি ছাড়েননি 

উরওয়া রাহ. বলেন, আয়েশা রা. বলেন-

كَانَ يَقُومُ مِنَ اللّيْلِ، حَتّى تَتَفَطّرَ قَدَمَاهُ، فَقَالَتْ عَائِشَةُ: لِمَ تَصْنَعُ هَذَا يَا رَسُولَ اللهِ، وَقَدْ غَفَرَ اللهُ لَكَ مَا تَقَدّمَ مِنْ ذَنْبِكَ وَمَا تَأَخّرَ؟ قَالَ: أَفَلاَ أُحِبّ أَنْ أَكُونَ عَبْدًا شَكُورًا.

(নবীজী) রাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এত বেশি নামায পড়তেন যে, তাঁর পাও মোবারক ফুলে যেতো। এ দেখে তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি এত কষ্ট করছেন, অথচ আপনার পূর্বাপর সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে! রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আমার কি উচিত নয় যে, (এই মহা অনুগ্রহের জন্য আল্লাহর ইবাদতের মাধ্যমে) আমি একজন পূর্ণ শোকর আদায়কারী বান্দা হব?’ -সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৮৩৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৮২০

উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. থেকেই বর্ণিত, রোগ-ব্যাধি কিংবা অন্য কোনো কারণে যদি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাহাজ্জুদ আদায় করতে না পারতেন, তবে দিনের বেলায় বারো রাকাত আদায় করে নিতেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৭৪৬

পাপ দূর করে দেয় 

হযরত আবু উমামা রা. থেকে বর্ণিত। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

عَلَيْكُمْ بِقِيَامِ اللّيْلِ فَإِنّهُ دَأَبُ الصّالِحِينَ قَبْلَكُمْ، وَهُوَ قُرْبَةٌ إِلَى رَبِّكُمْ، وَمَكْفَرَةٌ لِلسّيِّئَاتِ، وَمَنْهَاةٌ لِلإِثْمِ.

তোমরা কিয়ামুল লাইলের প্রতি যত্নবান

হও। কেননা তা তোমাদের পূর্ববর্তী সালেহীনের অভ্যাস এবং রবের নৈকট্য লাভের বিশেষ মাধ্যম। আর তা পাপরাশী মোচনকারী এবং গোনাহ থেকে বাধা প্রদানকারী। -জামে তিরমিযি, হাদীস ৩৫৪৯; মুসতাদরাকে হাকেম,  হাদীস ১১৫৬

জান্নাতিদের একটি বৈশিষ্ট্য 

পবিত্র কুরআনে মুত্তাকীদের জন্য জান্নাতের ঘোষণা দেয়া হয়েছে।

اِنَّ الْمُتَّقِیْنَ فِیْ جَنّٰتٍ وَّ عُیُوْنٍ.

সেদিন নিশ্চয়ই মুত্তাকীরা থাকবে প্রস্রবণবিশিষ্ট জান্নাতে। -সূরা যারিয়াত (৫১) : ১৫

সাথে তাদের কিছু গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্যের বিবরণও এসেছে। তন্মধ্যে অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল-

وَ بِالْاَسْحَارِ هُمْ یَسْتَغْفِرُوْنَ.

রাতের শেষ প্রহরে তারা ক্ষমা প্রার্থনা করত। -সূরা যারিয়াত (৫১): ১৮

ইবাদুর রহমান-রহমানের বান্দাদের কতিপয় বৈশিষ্ট বর্ণনা করা হয়েছে কুরআনে কারীমের সূরা ফুরকানে। সেখানেও উপরোল্লিখিত বৈশিষ্ট্যটি বিবৃত হয়েছে-

وَ الَّذِیْنَ یَبِیْتُوْنَ لِرَبِّهِمْ سُجَّدًا وَّ قِیَامًا.

আর তাঁরা রাত অতিবাহিত করে তাঁদের প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সিজদারত হয়ে এবং দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। -সূরা ফুরকান (২৫) : ৬৪

সূরার শেষের দিকে তাদের পুরস্কারের বিবরণও এসেছে-

اُولٰٓىِٕكَ یُجْزَوْنَ الْغُرْفَةَ بِمَا صَبَرُوْا وَ یُلَقَّوْنَ فِیْهَا تَحِیَّةً وَّ سَلٰمًا، خٰلِدِیْنَ فِیْهَا حَسُنَتْ مُسْتَقَرًّا وَّ مُقَامًا.

তাদের প্রতিদান দেয়া হবে জান্নাতের সুউচ্চ কক্ষ। কারণ তারা ছিল ধৈর্যশীল। তাদেরকে সেখানে অভ্যর্থনা করা হবে অভিবাদন ও সালাম সহকারে। সেখানে তারা স্থায়ী হবে। আশ্রয়স্থল ও বসতি হিসেবে তা কত উৎকৃষ্ট! -সূরা ফুরকান (২৫) :  ৭৫-৭৬

পরিশেষে

তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়ের নির্দেশ অনুসরণ করা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কার্য এবং এর ফজিলত অপরিসীম। এই নামাজের মাধ্যমে দুনিয়া ও আখেরাতে উভয়ই সফলতা পাওয়া সম্ভব। তাহাজ্জুদ নামাজের বাংলা নিয়ত এর মাধ্যমে মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন সম্ভব।

আল্লাহ তায়ালা সেই ব্যক্তিকে পছন্দ করেন যে একাকী রাতে সেজদারত অবস্থায় নামাজ আদায় করে। তাই সকলেরই নিয়মিত তাহাজ্জুদ নামাজের অভ্যাস করা উচিত।

তাহাজ্জুদ নামাজ সম্পর্কিত প্রশ্ন ও উত্তর / FAQ

১। তাহাজ্জুদ নামাজের দোয়া কি?

উত্তরঃ তবে এটা পড়া আবশ্যক মনে করা যাবে না বা এটা না পড়লে তাহাজ্জুদ নামাজ হবে না এমন ভাবা যাবে না। অর্থ : ‘হে আল্লাহ! সব প্রশংসা আপনারই, আপনিই আসমান-জমিন ও উভয়ের মাঝে বিদ্যমান সব কিছুর নিয়ামক এবং আপনারই জন্য সব প্রশংসা। আসমান-জমিন এবং এর মাঝে বিদ্যমান সব কিছুর কর্তৃত্ব আপনারই।

২। তাহাজ্জুদের সালাত কিভাবে আদায় করতে হয়?

উত্তরঃ তাহাজ্জুদ পড়ার নিয়ম হচ্ছে দুই রাকাত দুই রাকাত করে যথাসম্ভব লম্বা কেরাত, লম্বা রুকু ও সেজদা সহকারে একান্ত নিবিষ্ট মনে পড়া। কেরাত উঁচু বা নিচু উভয় আওয়াজে পড়া জায়েজ আছে। তবে কারও কষ্টের কারণ হলে চুপিচুপি পড়া কর্তব্য। রমজান ছাড়া অন্য সময় মাঝেমধ্যে জামাতে পড়া জায়েজ আছে তবে নিয়মিতভাবে নয়।

৩। তাহাজ্জুদ নামাজ কি নফল না সুন্নত?

উত্তরঃ আলেমদের মতে, তাহাজ্জুদ নামাজের বিধান সুন্নতে গায়রে মুআক্কাদা বা নফল। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এ নামাজ চার, ছয়, আট, ১০ রাকাত প্রমাণিত। এর থেকে বেশি বা কম পড়াতেও কোন সমস্যা নেই। যেহেতু নফল, তাই যত ইচ্ছা পড়া যায়।

আরও পড়ুন-

লাইলাতুল কদর, গৌরবময় রাতের গুরুত্ব ও মর্যাদা

Leave a Comment