নিম পাতার উপকারিতা ও অপকারিতা
দেশী নিম পাতার উপকারিতা ও অপকারিতা অনেক রয়েছে। ভেষজ গুণে পরিপূর্ণ গাছের নাম উল্লেখ করার সময় প্রথমেই যে নামটি মনে আসে তা নিম । এটি একটি চিরসবুজ ঔষধি গাছ যা অনেক বছর বেচে থাকে । এর বোটানিক নাম হলো : Azadirachta indica ।
যদিও ভেষজ এই গাছের পাতা, ডাল, রস সবই প্রাত্যাহিক জীবনে নানা রকম কাজে ব্যবহৃত হয় তবুও গাছের অন্য অংশের চেয়ে গাছের পাতাই মানুষ সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে । তার কারন গাছের অন্য অংশ গুলোর তুলনায় গাছের পাতা ব্যবহার করা অনেক বেশি সহজ এবং এতে এর ঔষধি বা ভেষজ গুণও সঠিক ভাবেই বজায় থাকে ।
প্রতিটা জিনিস এর যেমন ভাল খারাপ দিক রয়েছে ঠিক তেমন ভেষজ গুণে সম্পন্ন এই দেশী নিম পাতার উপকারিতা ও অপকারিতা উভয়ই রয়েছে । আমাদের সকলের এই এই বিষয়ে জানা উচিত। নিচে আলোচনা করা হলঃ
আরও পড়ুনঃ ডায়াবেটিস কমানোর উপায়
নিম পাতার উপকারিতা
নিম গাছ একটি চিরহরিৎ গাছ যা মহগনি পরিবারের অংশ। নিমকে সাধারণত ‘গ্রামের ঔষধালয়’ বলা হত কারণ এতে অসংখ্য স্বাস্থ্য সুবিধা রয়েছে। অনেক দেশে এই গাছের প্রায় প্রতিটি অংশই ঐতিহ্যগতভাবে বিভিন্ন ঔষধে ব্যবহৃত হয়
১. রক্ত থেকে দূষিত উপাদান দূর করে
মানব দেহের রক্ত থেকে দূষিত উপাদান দূর করে রক্ত পরিষ্কার করতে নিম পাতার রস বেশ কার্যকরী ভূমিকা পালন করে । নিয়মিত নিম পাতার রস গ্রহণের ফলে রক্তে শর্করার মাত্রা পরিমিত থাকে যার জন্য রক্ত পরিষ্কার থাকে । আর রক্ত থেকে দূষিত পর্দাথ দূর হওয়ার ফলে শরীরে কোনো রকম সমস্যা ছাড়াই রক্ত সঠিক ভাবে সঞ্চালিত হয় ।
২. ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে নিম পাতা
ম্যালেরিয়া রোগকে নির্মূল করতে অন্যতম ভূমিকা পালন করে নিম পাতা । ম্যালেরিয়া ছড়ায় মূলত স্ত্রী অ্যানোফিলিস মশার মাধ্যমে । ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায় । নিম পাতা সেই দুর্বল শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে । আবার নিম পাতাতে রয়েছে অ্যান্টি-ম্যালেরিয়া উপাদান যা ম্যালেরিয়া জীবাণু বহনকারী ব্যাকটেরিয়া সমূহকে ধ্বংস করতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে । ম্যালেরিয়া প্রতিরোধক ওষুধ তৈরীতেও নিম পাতা ব্যবহার করা হয় । এইজন্য নিম পাতা ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধক সমূহের মধ্যে অন্যতম ।
আরও পড়ুনঃ কালোজিরা ও রসুনের উপকারিতা
৩.আলসার নিরাময়ে নিমপাতা
আলসার এমন একটি রোগ যা মানুষের পরিপাকতন্ত্রে হয় । পরিপাকতন্ত্রে যখন এসিড বেশি মাত্রা তৈরী হলে সাধারণত এই রোগের সূত্রপাত ঘটে । তবে অনেক সময় এসিড সঠিক মাত্রায় থাকার পরেও আলসার দেখা দেয় এবং এটিকে সংক্রমণ ঘটিত আলসার বলে । সংক্রমণ ঘটিত ‘এইচ পাইলোরি’ নামক ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমনে হয়ে থাকে । তবে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে নিম পাতা এই রোগ নিরাময় করতে সক্ষম । নিম পাতাতে রয়েছে এন্টি ব্যাকটেরিয়াল উপাদান যা ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধ করে এবং অতিরিক্ত এসিডিটি নিয়ন্ত্রণ করে । নিয়মিত ভাবে দৈনিক সকালে খাওয়ার আগে নিম পাতার রস পান করলে আলসার সহজেই নিরাময় হয় ।
৪. ডায়াবেটিস রোগ নিয়ন্ত্রণে নিম পাতার কার্যকারিতা
ডায়াবেটিস (মধুমেহ) এর মতো রোগ মানব দেহে বাসা বাধার কারণ হচ্ছে শরীরে প্রয়োজনের তুলনায় কার্বোহাইড্রেট বেড়েযাওয়া । তবে নিমের মধ্যে এমন কিছু উপাদান রয়েছে যা শরীরে বেড়ে যাওয়া কার্বোহাইড্রেট নিয়ন্ত্রণ করে তা আবর সঠিক মাত্রায় ফিরিয়ে আনতে পারে । আবার এতে বিদ্যমান হাইপোগ্লাইসেমিক শরীরে উপস্থিত যে কোনো ধরনের ক্ষতিকর জীবাণুর বিপরীতে কাজ করে শরীরকে সুস্থ রাখে । অত এব , ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণেও নিম পাতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।
৫. হাই ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণ
হাই ব্লাড প্রেসার হওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে যার মধ্যে একটি কারণ হলো রক্তে উপস্থিত দুষিত পদার্থ । আর নিয়মিত নিম পাতার রস গ্রহণের মাধ্যমে রক্ত থেকে দুষিত পদার্থ দূর হয় এবং পাশাপাশি রক্ত সঞ্চালনে স্বাভাবিকতা বজায় থাকে । এই ভাবে হাই ব্লাড প্রেসারের মতো সমস্যা থেকে সমাধান পাওয়া যায় ।
৬. চুলের খুশকি সমস্যার সমাধান
নিম পাতাতে অনেক বেশি পরিমাণে ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক নাশক উপাদান বিদ্যমান রয়েছে যা মূলত খুশকি সমস্যা সমাধান করার জন্য দরকার হয় । চুলের খুশকি সমস্যার সমাধানের জন্য প্রথমে মিহি করে নিম পাতার পেস্ট তৈরি করে নিতে হবে । তারপর সেই পেস্ট চুলের স্ক্যাল্পে লাগিয়ে ২০ -২৫ মিনিট রাখতে হবে এবং তারপর শ্যাম্পু দিয়ে চুল ধুয়ে ফেলতে হবে। এভাবে সপ্তাহে দু দিন ব্যবহার করলে চুলের খুশকি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
৭. ক্যান্সার নিবারণে নিম পাতা
ক্যান্সার উৎপন্নকারী কোষগুলির বিরূদ্ধে কাজ করে লিওমনোয়েডস এবং স্যাকারাইডস নামের দুটি উপাদান যা নিম পাতাতে বিদ্যমান রয়েছে । একটি জরিপে দেখা গেছে যে নিয়মিত নিম পাতার রস গ্রহণকারী ব্যক্তিদের মাঝে খুব কম সংখ্যক মানুষই ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয়েছে । এজন্য নিয়মিত নিম পাতা বা এর রস গ্রহণ করা দরকার ।
৮. কৃমি নিরাময়ে নিম পাতা
কৃমির সমস্যা সাধারণত শিশুদের দেখা দেয় যে জন্য তাদের খাবারে অরুচি হয়, তাদের চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে যায় । বেশি সময় যাবৎ এই সমস্যা শরীরে থাকলে আস্তে আস্তে অন্য রোগও দেখা দিতে শুরু করে । কিন্তু নিম পাতা এই সমস্যা সহজেই সমাধান করতে পারে । এক গ্লাস পানিতে ৭-৮ টি নিমপাতা ফুটিয়ে নিয়ে সেই পানি গ্রহণ করলে অল্প দিনের মধ্যেই কৃমি নির্মূল হয়ে যাবে ।
৯. ত্বকের যত্নে নিমপাতা
নিম পাতায় রয়েছে অনেক পরিমাণে ভিটামিন ই যা স্কিনের জন্য প্রয়োজনীয় আদ্রতা প্রদান করতে সক্ষম । আবার এতে রয়েছে এন্টি ব্যাকটেরিয়াল প্রোপারটিস যা মুখের ব্ল্যাকহেডস, পিম্পলস বা ব্রণ , হোয়াইটহেডস ইত্যাদি সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে । এই সমস্যা গুলো দূর করতে হলে নিয়মিত নিম পাতা দিয়ে তৈরি ফেসপ্যাক ব্যবহার করতে হবে অথবা নিম পাতা সিদ্ধ করে সেই পানি মুখে লাগিয়ে রেখে ১৫ মিনিট পর নরমাল পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলতে হবে।
১০. বাত ব্যাথা প্রতিকারে নিম পাতা
আমাদের আশেপাশে এমন অনেক বৃদ্ধ মানুষ আছেন যারা বাতের ব্যাথায় ভুগছেন । তারা নিম পাতা থেকে তৈরীকৃত তেল দিয়ে সেই ব্যাথার জায়গা মালিশ করার মাধ্যমে বাতের ব্যাথার প্রতিকার করতে পারেন ।
১১. এলার্জি প্রতিরোধে নিম পাতা
প্রত্যেকটি মানুষের শরীরেই নানা রকমের এলার্জি থাকে। নিম পাতা এই এলার্জি ও প্রতিরোধে বেশ কার্যকর। এলার্জি প্রতিরোধ করার জন্য এলার্জি যেখানে হয়েছে সে জায়গায় নিম পাতা বেটে তার সাথে অল্প পরিমাণ গুঁড়ো হলুদ মিশিয়ে প্রলেপ লাগাতে হবে। এভাবে ৭ থেকে ৮ দিন ব্যবাহার করলে আরাম পাওয়া যাবে ।
আরও পড়ুনঃ লেবুর উপকারিতা ও অপকারিতা
নিম পাতার ক্ষতিকর দিক
তবে নিমের এত উপকারি গুণ দেখে কখনো ভাববেন যে এর কোনো অপকারিতা নেই । উপকারি গুণে ভরপুর এই নিম পাতার বেশ কিছু অপকারিতাও আছে । নিচে সেই অপকারিতাগুলো তুলে ধরা হলো :
- বয়স পাঁচ বছরের কম এমন বাচ্চাদের নিমপাতা গ্রহণ করা অনুচিত কারণ এতে তাদের বমি ভাব,শরীরে দুর্বলতা আবার কিছু কিছু সময় রে-সিন্ড্রোম দেখা দেয় ।
- যারা অল্পতেই ক্লান্তি অনুভব করে তাদের নিম অথবা নিম আছে এমন কোনো কিছু গ্রহণ করা উচিত নয় । কারন এতে তাদের ক্লান্তিভাব বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে ।
- দীর্ঘদিন যাবৎ নিম পাতার রস সেবন করলে কিডনির সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা থাকে ।
- পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে মহিলাদের নিমপাতা গ্রহণ করা উচিত নয় কারন এতে অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণ হয় ।
- ফ্যামিলি প্ল্যানিং করছেন এমন দম্পতিদের কখনো নিম পাতা গ্রহণ করা উচিত নয় কারন এটি পুরুষের স্প্যার্ম এর সংখ্যা কমিয়ে দেয় ।
- যারা গর্ভবতী তাদের নিম পাতা খাওয়া ঠিক নয় । কারন এতে গর্ভপাত এবং অকালে বাচ্চা হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে ।
- কোনো বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়া মেয়েদের নিম পাতা গ্রহণ করা যাবে না কারণ এটি বন্ধ্যত্বের কারণ হিসেবে দায়ী ।
- যেহেতু নিম পাতা উচ্চ রক্তচাপ কন্ট্রোল তা কমিয়ে স্বাভাবিক মাত্রায় আনতে পারে সেহেতু নিম্ন রক্তচাপ আছে এমন মানুষের নিম পাতা গ্রহণ করা উচিত নয় ।
শেষকথা:
নিমপাতা এমন একটি জিনিস যেটির উপকারিতা সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি জানা যায়। তবে মনে রাখতে হবে নিম পাতার উপকারিতা ও অপকারিতা উভয় আছে।