যাকাতের হিসাব সম্পর্কিত সকল তথ্য ও প্রয়োজনীয়তা

যাকাতের হিসাব

যাকাত ইসলামের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রোকন এবং ঈমানের পর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য ইবাদত। কুরআন মজীদে বহু স্থানে সালাত ও যাকাতের একসাথে উল্লেখ করা হয়েছে, যা তাদের গুরুত্বের স্পষ্ট নিদর্শন। এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-

وَ اَقِیْمُوا الصَّلٰوةَ وَ اٰتُوا الزَّكٰوةَ ؕ وَ مَا تُقَدِّمُوْا لِاَنْفُسِكُمْ مِّنْ خَیْرٍ تَجِدُوْهُ عِنْدَ اللّٰهِ ؕ اِنَّ اللّٰهَ بِمَا تَعْمَلُوْنَ بَصِیْرٌ۝۱۱۰

 ‘তোমরা সালাত আদায় কর এবং যাকাত প্রদান কর। তোমরা যে উত্তম কাজ নিজেদের জন্য অগ্রে প্রেরণ করবে তা আল্লাহর নিকটে পাবে। নিশ্চয়ই তোমরা যা কর আল্লাহ তা দেখছেন। – সূরা বাকারা : ১১০

অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-

وَ اَقِیْمُوا الصَّلٰوةَ وَ اٰتُوا الزَّكٰوةَ وَ اَطِیْعُوا الرَّسُوْلَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُوْنَ۝۵۶

‘তোমরা সালাত আদায় কর, যাকাত দাও এবং রাসূলের আনুগত্য কর যাতে তোমরা অনুগ্রহভাজন হতে পার।’-সূরা নূর : ৫৬।

সুতরাং যাকাতের হিসাব সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানা প্রয়োজন। আজকের আলোচনায় যাকাতের হিসাব সম্পর্কে সম্পূর্ণ আলোচনা করা হল।

আরও পড়ুনঃ ফিতরা কাকে দেওয়া যাবে, পরিমান ও আদায়ের নিয়ম

যাকাতের গুরুত্ব

যাকাতের হিসাব

আত্মশুদ্ধি

যাকাত দান করার মাধ্যমে ধনী ব্যক্তির সম্পদ পবিত্র হয় এবং লোভ-কৃপণতা দূর হয়।

সম্পদের বৃদ্ধি

যাকাত আদায়ের মাধ্যমে আল্লাহ্‌ তা’আলা ধন-সম্পদ বৃদ্ধি করেন।

দারিদ্র্য দূরীকরণ

যাকাত দারিদ্র্য দূরীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

সামাজিক ন্যায়বিচার

যাকাত সমাজে সাম্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে।

আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি

যাকাত দানের মাধ্যমে আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি অর্জন করা সম্ভব। যাকাতের গুরুত্বপূর্ণ সুফল বর্ণনা করে আল্লাহ তাআলা বলেন-

خُذْ مِنْ اَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَ تُزَكِّیْهِمْ بِهَا وَصَلِّ عَلَیْهِمْ ؕ اِنَّ صَلٰوتَكَ سَكَنٌ لَّهُمْ ؕ وَ اللّٰهُ سَمِیْعٌ عَلِیْمٌ۝۱۰۳

‘তাদের সম্পদ থেকে সদকা গ্রহণ করুন, যার দ্বারা আপনি তাদেরকে পবিত্র করবেন এবং পরিশোধিত করবেন এবং আপনি তাদের জন্য দুআ করবেন। আপনার দুআ তো তাদের জন্য চিত্ত স্বস্তিকর। আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’-সূরা তাওবা : ১০৩

যাকাতের হিসাব করার নিয়ম

  • নিসাব: যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য অন্তত নিসাব পরিমাণ সম্পদ এক বছর থাকতে হবে। স্বর্ণে নিসাব হলো সাড়ে সাত ভরি, রুপোতে সাড়ে বায়ান্ন ভরি, এবং নগদ টাকায় নিসাব পরিমাণ নির্ধারণ করা হয় স্বর্ণের বর্তমান বাজারমূল্যের উপর ভিত্তি করে।
  • হিসাব করার সময়: যাকাতের হিসাব করার সময় এক বছরের সময়কাল ধরা হয়।
  • যাকাতযোগ্য সম্পদ: স্বর্ণ, রুপো, নগদ টাকা, ব্যবসার পণ্য, শেয়ার, বীমা, সঞ্চয়পত্র, গবাদি পশু, ইত্যাদি।

যাকাতের হার

স্বর্ণ ও রুপোতে: ৪০ ভাগের ১ ভাগ

নগদ টাকা ও ব্যবসার পণ্যে: ৪০ ভাগের ১ ভাগ

গবাদি পশুতে: নির্দিষ্ট হার নির্ধারিত

যাকাতের হিসাব করার জন্য বিভিন্ন অনলাইন ক্যালকুলেটর পাওয়া যায়।

যাকাতের ফজিলত

জাহান্নাম থেকে মুক্তি: যাকাত দানকারী ব্যক্তি জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি পাবে।

জান্নাতে প্রবেশ: যাকাত দানকারী ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশের সুযোগ পাবে।

আল্লাহ্‌র রহমত ও মাগফিরাত: যাকাত দানকারী ব্যক্তি আল্লাহ্‌র রহমত ও মাগফিরাত লাভ করবে।

আল্লাহর আদেশ অমান্য করার কারণে তাদেরকে যে মর্মন্তুদ শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে তা-ও কুরআন মজীদে বলে দেওয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-

وَ لَا یَحْسَبَنَّ الَّذِیْنَ یَبْخَلُوْنَ بِمَاۤ اٰتٰىهُمُ اللّٰهُ مِنْ فَضْلِهٖ هُوَ خَیْرًا لَّهُمْ ؕ بَلْ هُوَ شَرٌّ لَّهُمْ ؕ سَیُطَوَّقُوْنَ مَا بَخِلُوْا بِهٖ یَوْمَ الْقِیٰمَةِ ؕ وَ لِلّٰهِ مِیْرَاثُ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ ؕ وَ اللّٰهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ خَبِیْرٌ۠۝۱۸۰

আর আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে যা তোমাদেরকে দিয়েছেন তাতে যারা কৃপণতা করে তারা যেন কিছুতেই মনে না করে যে, এটা তাদের জন্য মঙ্গল। না, এটা তাদের জন্য অমঙ্গল। যে সম্পদে তারা কৃপণতা করেছে কিয়ামতের দিন তা-ই তাদের গলায় বেড়ি হবে। আসমান ও যমীনের স্বত্ত্বাধিকার একমাত্র আল্লাহরই। তোমরা যা কর আল্লাহ তা বিশেষভাবে অবগত। -সূরা আলইমরান : ১৮০

যাকাত ফরয হবার শর্তাবলী

যাকাত ফরয হওয়ার জন্য নিম্নলিখিত শর্তগুলো পূরণ করতে হবে:

মুসলিম হওয়া: অমুসলিমের উপর যাকাত ফরয নয়।

স্বাধীন হওয়া: দাসের উপর যাকাত ফরয নয়।

বুদ্ধিমান হওয়া: পাগলের উপর যাকাত ফরয নয়।

বালেগ হওয়া: প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত যাকাত ফরয নয়।

নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়া: নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ এক বছর ধরে থাকলে যাকাত ফরয হয়।

যাদের উপর যাকাত ফরয

ধনী ব্যক্তি: যার কাছে নিসাব পরিমাণ সম্পদ এক বছর ধরে রয়েছে তার উপর যাকাত ফরয।

ব্যবসায়ী: ব্যবসার পণ্যের উপর যাকাত ফরয।

কৃষক: ফসলের উপর যাকাত ফরয।

গবাদি পশুর মালিক: নির্দিষ্ট সংখ্যক গবাদি পশুর উপর যাকাত ফরয।

খনিজ সম্পদের মালিক: খনিজ সম্পদের উপর যাকাত ফরয।

যাদের উপর যাকাত ফরয নয়

গরিব ও মিসকিন: যাদের আয় ও সম্পদ তাদের ও তাদের পরিবারের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য যথেষ্ট নয় তাদের উপর যাকাত ফরয নয়।

ঋণগ্রস্ত: ঋণের পরিমাণ যদি সম্পদের পরিমাণের চেয়ে বেশি হয় তবে ঋণ পরিশোধের পূর্বে যাকাত ফরয নয়।

দাস: দাসের উপর যাকাত ফরয নয়।

অমুসলিম: অমুসলিমের উপর যাকাত ফরয নয়।

পাগল: পাগলের উপর যাকাত ফরয নয়।

প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া: প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত যাকাত ফরয নয়।

কুরআন মজীদে যাকাতের খাত নির্ধারিত করে দেওয়া হয়েছে। এখাত ছাড়া অন্য কোথাও যাকাত প্রদান করা জায়েয নয়। ইরশাদ হয়েছে-

اِنَّمَا الصَّدَقٰتُ لِلْفُقَرَآءِ وَ الْمَسٰكِیْنِ وَ الْعٰمِلِیْنَ عَلَیْهَا وَ الْمُؤَلَّفَةِ قُلُوْبُهُمْ وَ فِی الرِّقَابِ وَ الْغٰرِمِیْنَ وَ فِیْ سَبِیْلِ اللّٰهِ وَ ابْنِ السَّبِیْلِ ؕ فَرِیْضَةً مِّنَ اللّٰهِ ؕ وَ اللّٰهُ عَلِیْمٌ حَكِیْمٌ۝۶۰

যাকাত তো কেবল নিঃস্ব, অভাবগ্রস্ত ও যাকাতের কাজে নিযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য, যাদের মনোরঞ্জন উদ্দেশ্য তাদের জন্য, দাসমুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে জিহাদকারী ও মুসাফিরের জন্য। এ আল্লাহর বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।-সূরা তাওবা : ৬০

যাকাত কখন দিতে হবে

যাকাত কখন দিতে হবে সে সম্পর্কে কিছু মতামত রয়েছে-

১. বছরের যেকোনো সময়: অনেকে মনে করেন, বছরের যেকোনো সময় যাকাত প্রদান করা যাবে। তবে, রমজান মাসে যাকাত প্রদানের ফজিলত অনেক বেশি।

২. সম্পদ অর্জনের পর: যখনই কারো কাছে নিসাব পরিমাণ সম্পদ জমা হবে, তখনই সে যাকাত প্রদান করবে।

৩. হিজরি সনের শুরুতে: অনেকে মনে করেন, হিজরি সনের শুরুতে যাকাত প্রদান করা উচিত।

৪. রমজান মাসে: অধিকাংশ আলেম মনে করেন, রমজান মাসে যাকাত প্রদান করা সর্বোত্তম। কারণ, রমজান মাসে যাকাত প্রদানের ফজিলত অনেক বেশি।

যাকাত প্রদানের সর্বোত্তম সময়

  • রমজান মাসের শেষ দশ দিনে
  • ঈদের দিন
  • ঈদের আগের দিন

যাকাত প্রদানের সময়

  • যাকাত প্রদানের সময় গোপনীয়তা বজায় রাখা উচিত।
  • যাকাত প্রদানের সময় গরিব ও মিসকিনদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া উচিত।
  • যাকাত প্রদানের সময় আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্য রাখা উচিত।

আরও পড়ুন-

নতুন বছরের ইসলামিক স্ট্যাটাস সম্পর্কিত তথ্য

দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তির দোয়া, ইবাদত ও জীবনধারণ

Leave a Comment