লাইলাতুল কদর
লাইলাতুল কদর ইসলামের একটি বিশেষ রাত। এটি মুসলিম সমাজে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং পবিত্র হিসাবে মর্যাদা পায়।
এই রাতে মুসলিমরা প্রার্থনা করে, কোরআন পড়ে এবং পরিবারের সদস্যদের সাথে আলোচনা করে কী ভাবে এই বিশেষ রাতটি পালন করা যায়।
এই রাতে পূর্ণ সমর্থন, সম্মান, এবং ধার্মিক ভাবে উত্সাহিত হয়। লাইলাতুন শব্দের অর্থ হলো “রাত্রি” বা “রজনী”, এবং কদর শব্দের অর্থ হলো “মর্যাদা”, “বিশেষ গুরুত্ব”।
এ রাতে নবী মোহাম্মদ (সাঃ) এর অনুসারীদের জন্য বিশেষ সম্মান প্রদান হয় এবং মানবজাতির পুনর্নির্ধারণে প্রধান ভূমিকা পালন করা হয়।
এই পবিত্র রাত অত্যন্ত শ্রেষ্ঠ এবং মহাসম্মানিত হিসেবে মন্নিত হয়। কুরআনে এই রাত্রিকে একটি অনন্য গুরুত্বপূর্ণ সময় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং এই রাতের উপাসনা আমল করার মাধ্যমে অতিরিক্ত সওয়াব অর্জন করা যায়।
প্রতিবছরে মাহে রমজানে লাইলাতুল কদর রজনী মুসলিম সমাজের জন্য একটি বিশেষ সৌভাগ্যবর সময়। আজকের আর্টিকেলে লাইলাতুল কদর এর মর্যাদা,গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে আলোচনা করব।
আরও পড়ুনঃ দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তির দোয়া, ইবাদত ও জীবনধারণ
কোন রাতটি লাইলাতুল কদর
লাইলাতুল কদর কোন নির্দিষ্ট রাতে পালিত হয় না। এটি রমজান মাসের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোর একটিতে (২৭, ২৯, ২৫) পালিত হয়।
কোন রাতটি লাইলাতুল কদর তা জানার কোন সুনির্দিষ্ট উপায় নেই। তবে কিছু আলামত দেখা যায় যা লাইলাতুল কদরের রাতের সাথে সম্পর্কিত বলে মনে করা হয়।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
تَحَرُّوْا لَيْلَةَ الْقَدْرِ فِي الْعَشْرِ الأوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ
‘‘রমাযানের শেষ দশদিনে তোমরা কদরের রাত তালাশ কর।’’ (বুখারী : ২০২০; মুসলিম : ১১৬৯)
উবাই ইবনে কাব হতে বর্ণিত হাদীসে এসেছে, তিনি বলেন যে,
وَاللهِ إِنِّيْ لأَعْلَمُ أَيُّ لَيْلَةٍ هِيَ اللَّيْلَةُ الَّتِيْ أَمَرَنَا رَسُوْلُ اللهِ -صلى الله عليه وسلم- بِقِيَامِهَا هِىَ لَيْلَةُ سَبْعٍ وَعِشْرِيْنَ
আল্লাহর শপথ করে বলছি, আমি যতদূর জানি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে যে রজনীকে কদরের রাত হিসেবে কিয়ামুল্লাইল করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন তা হল রমাযানের ২৭ তম রাত। (মুসলিম : ৭৬২)
আব্দুল্লাহ বিন ‘উমার থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
مَنْ كَانَ مُتَحَرِّيْهَا فَلْيَتَحَرِّهَا لَيْلَةَ السَّبْعِ وَالْعِشْرِيْنَ
‘‘যে ব্যক্তি কদরের রাত অর্জন করতে ইচ্ছুক, সে যেন তা রমাযানের ২৭শে রজনীতে অনুসন্ধান করে। (আহমাদ : ২/১৫৭)
কদর এর রাতকে অস্পষ্ট রাখার কারন
লাইলাতুল কদরের রাতকে অস্পষ্ট করে গোপন রাখার বেশ কিছু কারণ রয়েছে।
কয়েকটি সম্ভাব্য কারণ
- সকল রাত সমানভাবে ইবাদত করার জন্য: যদি নির্দিষ্ট রাতটি জানা থাকত, তাহলে মানুষ শুধুমাত্র সেই রাতেই ইবাদত করত এবং অন্য রাতগুলোকে অবহেলা করত।
- ইবাদতের আন্তরিকতা বৃদ্ধি: রাতটি গোপন রাখার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ইবাদত করবে, কেবলমাত্র রাতের পুণ্য লাভের জন্য নয়।
- কষ্ট ও পরিশ্রমের মূল্যবোধ: রাতটি খুঁজে বের করার জন্য মানুষকে কষ্ট করতে হবে, যা তাদের ইবাদতের মূল্য বৃদ্ধি করবে।
- ঈমান ও বিশ্বাস পরীক্ষা: রাতটি গোপন রাখার মাধ্যমে মুসলিমদের ঈমান ও বিশ্বাস পরীক্ষা করা হয়।
- বিশেষ রহস্য: লাইলাতুল কদরের রাতের বিশেষ গুরুত্ব ও রহস্য আছে যা আল্লাহ তায়ালা কেবল তার ইচ্ছামত বান্দাদের কাছে প্রকাশ করেন।
যদিও রাতটি নির্দিষ্ট করে বলা হয় না, তবুও রমজান মাসের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোকে সম্মানের সাথে কাটানো উচিত।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
فَمَنْ كَانَ مُتَحَرِّيْهَا فَلْيَتَحَرِّهَا فِي السَّبْعِ الأَوَاخِرِ
‘‘যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদর (কদরের রাত) অন্বেষণ করতে চায়, সে যেন রমাযানের শেষ সাত রাতের মধ্য তা অন্বেষণ করে।’’ (বুখারী : ২০১৫; মুসলিম : ১১৬৫)
লাইলাতুল কদর এর আলামত
কিছু আলামত আছে যা লাইলাতুল কদরের রাতের সাথে সম্পর্কিত বলে মনে করা হয়।
তবে মনে রাখতে হবে এই আলামতগুলো নিশ্চিত নয়, বরং সম্ভাব্য।
লাইলাতুল কদরের কিছু আলামত রয়েছে-
- রাতটি অত্যন্ত শান্ত ও প্রশান্তিপূর্ণ থাকে।
- চাঁদ পূর্ণিমা চাঁদের মতো উজ্জ্বল থাকে।
- রাতের আকাশে মেঘ দেখা যায় না।
- রাতের শেষ ভাগে হালকা বৃষ্টি হতে পারে।
- ফজরের আগে হালকা বাতাস বইতে পারে।
- মানুষ ইবাদত করে অপেক্ষাকৃত তৃপ্তিবোধ করবে।
- কোনো ঈমানদার ব্যক্তিকে আল্লাহ স্বপ্নে হয়তো তা জানিয়ে দিতে পারেন।
- সকালে হালকা আলোকরশ্মিসহ সূর্যোদয় হবে, যা হবে পূর্ণিমার চাঁদের মতো।
এই আলামতগুলো দেখা গেলে ধারণা করা যায় যে, এটি হতে পারে লাইলাতুল কদরের রাত।
রমজানের শেষ দশ রাতের ইবাদাত
রমজানের শেষ দশ রাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশেষভাবে ইবাদতের প্রতি মনোনিবেশ করতেন। তাঁর ইবাদতের ধরন ছিল নিম্নরূপ:
প্রথম ২০ রাত
- পূর্ণ রাত জাগরণ করতেন না।
- কিছু সময় ইবাদত করতেন, আর কিছু অংশ ঘুমিয়ে কাটাতেন।
শেষ দশ রাত
- বিছানায় একেবারেই যেতেন না।
- রাতের পুরো অংশটাই ইবাদত করে কাটাতেন।
- কুরআন তিলাওয়াত, সালাত আদায়, সদাকা প্রদান, যিকর, দু’আ, আত্মসমালোচনা ও তাওবাহ করে কাটাতেন।
- আল্লাহর রহমাতের আশা ও তার গজবের ভয়ভীতি নিয়ে সম্পূর্ণ খুশুখুজু ও বিনম্রচিত্তে ইবাদতে মশগুল থাকতেন।
কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য
- শক্ত করে তার লুঙ্গি দ্বারা কোমর বেঁধে নিতেন।
- নিজে যেমন অনিদ্রায় কাটাতেন তাঁর স্ত্রীদেরকেও তখন জাগিয়ে দিতেন ইবাদত করার জন্য।
- কদরের রাতের ইবাদতের সুযোগ যাতে হাতছাড়া না হয়ে যায় সেজন্য শেষ দশদিনের পুরো সময়টাতে ইতেকাফরত থাকতেন।
আমাদের করণীয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ করে শেষ দশ রাতে বিশেষভাবে ইবাদতের প্রতি মনোনিবেশ করা উচিত। রাত জেগে ইবাদত করা, কুরআন তিলাওয়াত করা, দোয়া করা, তাওবাহ করা ইত্যাদি করা উচিত।
লাইলাতুল কদরের রাতের সন্ধানে চেষ্টা করা উচিত।
লাইলাতুল কদরে যেসব ইবাদত করতে পারি
মহিমান্বিত লাইলাতুল কদর হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। এই রাতে আমরা বিভিন্ন ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে ক্ষমা, রহমত ও বরকত লাভ করতে পারি।
নামাজ
- তাহাজ্জুদ নামাজ: লাইলাতুল কদরের রাতে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার বিশেষ ফজিলত রয়েছে।
- ইতিকাফ: মসজিদে ইতিকাফ করে রাত জেগে ইবাদত করা।
- তারাবীহ: রমজানের প্রতি রাতে তারাবীহ নামাজ পড়া সুন্নত।
- তাওয়াহ: কাবা ঘরের চারদিকে তাওয়াহ করা।
কুরআন তেলাওয়াত
- পুরো কুরআন তেলাওয়াত করা।
- কিছু নির্দিষ্ট সূরা তেলাওয়াত করা, যেমন সূরা ইয়া-সিন, সূরা কদর, সূরা ফালাক, সূরা না।
- কুরআনের তাফসীর ও অর্থ অনুধাবন করা।
দোয়া ও যিকির
- আল্লাহর কাছে ক্ষমা, রহমত ও বরকতের জন্য দোয়া করা।
- বিভিন্ন যিকির ও তাসবীহ পড়া।
- দরুদ শরীফ পাঠ করা।
অন্যান্য
- সদকা ও দান করা।
- গরিব-দুঃখীদের খাবার করানো।
- রোজা রাখা।
- পরিবার-পরিজন ও বন্ধু-বান্ধবদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা।
- পাপ কাজ থেকে বিরত থাকা।
তাসবীহ তাহলীল ও যিকর-আযকার করবেন। তবে যিকর করবেন চুপিসারে, নিরবে ও একাকী এবং কোন প্রকার জোরে আওয়ায করা ছাড়া। এভাবে যিকর করার জন্যই আল্লাহ কুরআনে বলেছেন :
﴿ وَٱذۡكُر رَّبَّكَ فِي نَفۡسِكَ تَضَرُّعٗا وَخِيفَةٗ وَدُونَ ٱلۡجَهۡرِ مِنَ ٱلۡقَوۡلِ بِٱلۡغُدُوِّ وَٱلۡأٓصَالِ وَلَا تَكُن مِّنَ ٱلۡغَٰفِلِينَ ٢٠٥ ﴾ [الاعراف: ٢٠٥]
‘‘সকাল ও সন্ধ্যায় তোমার রবের যিকর কর মনে মনে বিনয়ের সঙ্গে ভয়ভীতি সহকারে এবং জোরে আওয়াজ না করে। এবং কখনো তোমরা আল্লাহর যিকর ও স্মরণ থেকে উদাসীন হয়োনা।’’ (আরাফ : ২০৫)
তাছাড়া নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ রাতে নিম্নের এ দু‘আটি বেশি বেশি করার জন্য উৎসাহিত করেছেন :
اَللَّهُمَّ إِنَّكَ عَفُوٌّ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّيْ
‘‘হে আল্লাহ! তুমি তো ক্ষমার আধার, আর ক্ষমা করাকে তুমি ভালবাস। কাজেই তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। (তিরমিযী : ৩৫১৩)
আরও পড়ুন-
ইসলামিক শিক্ষামূলক উক্তি, মূল্যবান বানী ও তথ্য
নতুন বছরের ইসলামিক স্ট্যাটাস সম্পর্কিত তথ্য