যাকাত হিসাব করার নিয়ম ও যাকাতের সঠিক পরিমান

যাকাত হিসাব করার নিয়ম

ইসলামে সমাজের দরিদ্র জনসাধারণের আর্থিক প্রয়োজনের ব্যাপকতার প্রতি লক্ষ্য রেখে তৃতীয় হিজরিতে ধনীদের ওপর যাকাত ফরজ করা হয়েছে। যাকাত হিসাব করার নিয়ম সম্পর্কে সকলের সঠিকভাবে জানা দরকার।

সমাজে ধনসম্পদের আবর্তন ও বিস্তার সাধন এবং দারিদ্র্য দূরীকরণের মহান উদ্দেশ্যেই যাকাত ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। দারিদ্র বিমোচন ও বেকার সমস্যা সমাধানই যাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য।

রমজান মাসে যাকাত প্রদান করা উত্তম। এই মাসের যেকোনো একটি দিনকে বছরের সমাপনী দিন ধরে যাকাতযোগ্য খাতের সব সম্পদের হিসাব করে যাকাত নির্ধারণ করতে হবে।

যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য অন্তত নিসাব পরিমাণ সম্পত্তি পূর্ণ এক চান্দ্র বছর (৩৫৪ দিন) থাকতে হবে। সম্পূর্ণ সম্পত্তির বছর পার হওয়া শর্ত নয়।

যাকাত বন্টণের খাতসমূহ সম্পর্কে মহান আল্লাহ তা ‘আলা কুরআনুল কারীমে উল্লেখ করেন, সাদকা বা যাকাত তো কেবল নিঃস্ব, অভাবগ্রস্থ, যাকাত আদায়কারী কর্মচারীদের জন্য, যাদের চিত্তাকর্ষণ করা হয় তাদের জন্য, দাস মুক্তির জন্য,ঋণ ভারাক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য,আল্লাহর পথে সংগ্রামকারী ও মুসাফিরদের জন্য।এটা আল্লাহর বিধান।

                                                                                        (সূরা আত তওবা -আয়াত ৬০)

আরও পড়ুনঃ যাকাতের হিসাব সম্পর্কিত সকল তথ্য ও প্রয়োজনীয়তা

যাকাত হিসাব করার মানদণ্ড

যাকাত হিসাব করার নিয়ম

ইসলামে ধনী ব্যক্তিদের ধনসম্পদের চল্লিশ ভাগের এক ভাগ অসহায় দরিদ্রদের মধ্যে যাকাত হিসেবে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।যাকাত দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট কোনো সময়ের বাধ্যবাধকতা না থাকলেও রমজান মাসই যাকাত আদায় করার সর্বোত্তম সময়।পুরো রমজান মাসে যেকোনো ধরনের দান-সাদকা করলে অন্য সময়ের চেয়ে ৭০ গুণ বেশি নেকি পাওয়া যায়।

আমাদের যে সম্পদের ওপর যাকাত ধার্য করা হয় তা সাধারণত পাঁচ প্রকারের হয়ে থাকে।যে সম্পদের ওপর যাকাত ধার্য করা হয়েছে  এবং যাকাত হিসাব করার নিয়ম নিচে উল্লেখ করা হলো

প্রথম প্রকার – স্বর্ণ এবং দ্বিতীয় প্রকার – রৌপ্যঃ

স্বর্ণ এবং রৌপ্য যেকোনো রুপে,যে কোনো উদ্দ্যেশে আপনার মালিকানায় থাকুক না কেন,যেমন:-অলংকার আকারে,বাণিজ্যিক আকারে বা কারো কাছে আমানত বন্ধক বা গচ্ছিত থাকা স্বর্ণ।যেকোনো রুপে থাকলেই তার ওপর যাকাত ধার্য করা হবে।

স্বর্ণে যাকাত ফরজ হবে যদি স্বর্ণ স্বতন্ত্রভাবে সাড়ে সাত তোলা বা ৮৭.৪৫ গ্রাম বা এর থেকে বেশি হয়।রৌপ্যে যাকাত ফরজ হবে যদি রৌপ্য স্বতন্ত্রভাবে সাড়ে বায়ান্ন তোলা বা ৬১২.৪৫ গ্রাম এর চেয়ে বেশি হয়।

তখন স্বর্ণ ও রৌপ্যের সরাসরি চল্লিশ ভাগের একভাগ বা মোট মূল্যের ৪০ ভাগের এক ভাগ যাকাত হিসেবে আদায় করতে হবে।

যাকাত হিসাব করার নিয়ম – তৃতীয় প্রকার – টাকা

টাকা বিভিন্নভাবে আমাদের কাছে থাকতে পারে।যেমন:-

  • নগদ টাকা
  • কারো কাছে আমানত রাখা টাকা।
  • ভবিষ্যতে কোনো উদ্দেশ্যে জমানো টাকা।যেমন হজ্জ,বিয়েশাদি,বাঢ়ি নির্মাণের উদ্দেশ্য টাকা।
  • ব্যাংকে জমানো টাকা বৈদেশিক মুদ্রা হলে তার মার্কেট মূল্য।
  • বীম ইন্সুরেন্সে জমানো টাকা ও প্রাইজবন্ট।
  • কর্জ টাকা বা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
  • যেকোনো ফেরত যোগ্য টাকা।যেমন:- এ্যাডভান্স সিকিউরিটি,জামানত রাখা টাকা,যার মূল্য বা বিকল্প আসবে।
  • মুদারাবা সঞ্চয়ী ফান্ড অংশীদ্বারিত্বের চুক্তিতে যে পুঁজি বিনিয়োগ করা হয় তার মূল পুঁজি এবং মুনাফা সহ হালাল টাকা।
  • স্বর্ণ ও রৌপ্য যদি স্বতন্ত্রভাবে নির্ধারিত পরিমাপের কম হয় তবে এর মূল্য নগদ টাকা হিসেবে ধার্য করা  হবে।
  • গাড়ি,বাড়ি, দোকান ইত্যাদির ভাড়া।

হারাম টাকার যাকাত নির্ধারণ করা হয়না ।হারাম টাকা সম্পূর্ণভাবে মূল মালিকের কাছে ফেরত দেওয়া জরূরি।

হজ্জের উদ্দেশ্যে কিংবা ঘরবাড়ি নির্মাণ, ছেলে-মেয়ের বিয়েশাদি ইত্যাদি প্রয়োজনের জন্য যে অর্থ সঞ্চয় করা হয়, তাঁতেও যাকাত দিতে হবে। 

                                              (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস : ১০৩২৫)

চতুর্থ প্রকার – চতুষ্পদ জন্তু বা গবাদি পশু

আপনার যদি স্বতন্ত্রভাবে ছাগল ৪০ টি,গরু ৩০ টি এবং উট ৫ টি অথবা এর থেকে বেশি থাকে তবে সুনির্দিষ্ট হারে গবাদি পশুর যাকাত ফরজ হয়।গবাদি পশু এই সংখ্যায় না পৌঁছালে ব্যবসায়িক সম্পদ হিসেবে গণ্য হবে।

পঞ্চম প্রকার – ব্যবসায়িক সম্পদ

 দোকানের মালামাল। বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে কেনা জমি, গাড়ি, গবাদি পশু(যদি নির্দিষ্ট সংখ্যক না হয়ে থাকে)।
একটি কোম্পানির নির্দিষ্ট শেয়ার মূল্য।

দোকান অথবা যা কিছু বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে রাখা হয়, তা বাণিজ্যিক পণ্য। এর মূল্য নিসাব পরিমাণ হলে যাকাত আদায় করা ফরজ। 

                                             (সুনানে আবু দাউদ : ১/২১৮)

উপরিউক্ত সব খাতে আপনার মালিকানার সব সম্পদ সমূহ যোগ করে যে পরিমাণ টাকা হবে,সেই টাকা থেকে নিচের গুলো বিয়োগ করতে হবে।  

১) সব ধরনের ভাড়া এবং বিল।যেমন:বাড়ির,গুদাম,দোকান,বিদ্যুৎ,গ্যাস,পানি, ইন্টারনেটের বিল ইত্যাদি।

২) কর্মচারীদের বেতন। আপনার ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান হোক অথবা বাসাবাড়িই হোক।

৩) বাকিতে ক্রয় করা দ্রব্যের মূল্য বা যে কোনো প্রকার ঋণ।

৪) বিগত বছরের অনাদায়ী যাকাতের পরিমাণ।

মোট সম্পত্তি থেকে এই চার খাতের মোট টাকা বিয়োগ করবেন, দেখতে হবে আপনার মালিকানায় মোট কত টাকা বাকি আছে?

অতঃপর যাকাত দেওয়ার পূর্বে আপনার নেসাব চিহ্নিত করে যাকাত প্রদান করতে হবে।

পরিশেষে

ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে একটি হচ্ছে যাকাত।ঈমানের পর নামাজ তারপরই যাকাতের স্থান।একারণে মুসলিম হিসেবে যাকাত হিসাব করার নিয়ম ও এ সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য জানা খুবই জরুরি। 

আজকের আর্টিকেলে মূলত আমরা আপনাদেরকে যাকাত হিসাব করার নিয়ম সম্পর্কে জানিয়েছি।আশা করা যায় আজকের আর্টিকেলটি পড়ে আপনারা যাকাত হিসাব করার নিয়ম সম্পর্কে জানতে পেরেছেন।ধৈর্য্য সহকারে সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

যাকাত সম্পর্কিত প্রশ্ন ও উত্তর/FAQ

১) যাকাতের ভিত্তি কিভাবে হিসাব করব?

উত্তর: যাকাতের ভিত্তি = তহবিলের উৎস x [জাকাতযোগ্য সম্পদ ÷ মোট সম্পদ] । যাকাত গণনার সূত্র প্রয়োগের পদ্ধতি: যাকাত সাপেক্ষে তহবিলের উৎস নির্ধারণ। 

২) সোনার তোলা কত?

উত্তর: তোলা – উইকিপিডিয়া

১ তোলা = ০.৩৭৫ ট্রয় আউন্স = ১১.৬৬৩৮০৩৮ গ্রাম। এই এককটি বর্তমানে স্বর্ণ এবং খুবই ক্ষুদ্র পরিমাণের পদার্থের পরিমাপে ব্যবহার হয়।

৩) যাকাতের খাত গুলো কি কি?

উত্তর: যাকাত বণ্টনের খাতসমূহ

ফকির (যার কিছুই নেই)

মিসকীন(যার নেসাব পরিমাণ সম্পদ নেই)

যাকাত আদায়ে নিযুক্ত কর্মচারী (যার অন্য জীবিকা নেই)

নওমুসলিমদের(আর্থিক সংকটে থাকলে)

ক্রীতদাস(মুক্তির উদ্দেশ্যে)

ধনী সম্পদশালী ব্যক্তি যার সম্পদের তুলনায় ঋণ বেশি

(স্বদেশে ধনী হলেও বিদেশে) আল্লাহর পথে জেহাদে রত ব্যক্তি

আরও পড়ুন-

ইসলামিক শিক্ষামূলক উক্তি, মূল্যবান বানী ও তথ্য

দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তির দোয়া, ইবাদত ও জীবনধারণ

Leave a Comment