গ্রামের মেলা বাংলার ঐতিহ্য

গ্রামের মেলা

গ্রাম প্রধান বাংলাদেশে আনন্দ-উল্লাস এর জন্য যে সকল অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয় তাদের মধ্যে গ্রামের মেলাবাংলার ঐতিহ্য ও মিলন মেলা অন্যতম। গ্রামের মেলা বিশ্ব দরবারে আমাদের সংস্কৃতিকে তুলে ধরে। আমাদের দেশে ধর্মীয়, সামাজিক, বাণিজ্যিক এমন নানা উপলক্ষে মেলা অনুষ্ঠিত হয়।

যেমন: পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে মেলা, দূর্গাপুজা উপলক্ষে মেলা বা ব্যবসা-বানিজ্য উপলক্ষে মেলা ইত্যাদি। বর্তমানে গ্রামের মেলা শুধুমাত্র গ্রামের মধ্যেই সিমাবদ্ধ নেই। এখন শহর এলাকায়ও হর-হামেশা মেলা দেখা যাচ্ছে। নাগরদোলা, জারি-সারি, পুতুল নাচ, গম্ভীরা কীর্তন

, লাঠি খেলা, ষাঁড়ের লড়াই, হাডুডু খেলা মেলার প্রধান আকর্ষন যা মেলায় আগত দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে তোলে। এছাড়াও নানা ধরনের মিষ্টি-মিষ্টন্ন ও মুখোরুচক খাবার তো আছেই। আবার মেলাকে কেন্দ্র করে রাতে আয়োজন করা হয় নাটক বা যাত্রাপালার । এ সকল আয়োজনকে কেন্দ্র করে গ্রামীণ জীবনে আসে প্রাণচাঞ্চল্য।

গ্রামের মেলা বাংলার সকল ধর্মের মানুষের সংস্কৃতির সমন্বয়। যদিওবা অনেক সময় আলাদা আলাদা ধর্মেকে কেন্দ্র করে মেলা অনুষ্ঠিত হয় তথাপি মেলায় আগত বিভিন্ন ধর্ম-বর্নের দর্শনার্থীদের মিলনে এক অন্যরকম পরিবেশ তৈরি হয় যাতে করে মেলা আর কোন নির্দিষ্ট ধর্ম বা বর্নের থাকে না।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র দীন একাকী। কিন্তু উৎসবের দিন মানুষ বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ’।

কবিগুরু যথার্থই বলেছেন। উপলক্ষ যাই হোক না কেন, বাঙালির সকল উৎসবের মধ্যে একটা সার্বজনীন রূপ আছে। এতে ধর্ম, সম্প্রদায়, জাত-পাত বা ধনী-গরিবের সামাজিক বিভক্তি বাধা হয়ে দাঁড়ায় না বরং সকল শ্রেণির মধ্যে সেতুবন্ধন রচিত হয়।

বাংলাদেশের মেলার উপলক্ষ সমূহ

বাংলাদেশের প্রায় সকল জেলা উপজেলায় জাতী, ধর্ম, বর্নভেদে মেলার আয়োজন করা হয়ে থাকে। ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) কর্তৃক গ্রামীণ মেলার ওপর দেশজুড়ে এক জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করে । যে জরিপে প্রায় ১ হাজার ৫টি মেলার সন্ধান পাওয়া যায়। এই জরিপটি আরও ৫০-৭০ বছর আগে অনুষ্ঠিত হলে এই মেলার সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেত বলে ধারনা করা হয়। এই জরিপে প্রাপ্ত ৯০%- ই গ্রামীণ মেলা।

আরও জানুনঃ অনলাইনে ট্রেনের টিকিট কাটার নিয়ম

বাংলার মেলাগুলোকে নিম্নোক্তভাবে ভাগ করা যায়

  • বিভন্ন ঋতুভিত্তিক মেলা।
  • বাণিজ্যিক সামগ্রী প্রদর্শনী ও বিক্রয় মেলা।
  • কৃষি উৎসব উপলক্ষে মে।
  • সাধু-সন্তের, পীর-আওলিয়ার ওরস উপলক্ষে মেলা।
  • জাতীয় জীবনের বিভিন্ন বরেণ্য ব্যক্তির নামে মে।
  • জাতীয় দিবসসমূহ উপলক্ষে মেলা।
  • ধর্মীয় অনুষ্ঠান উপলক্ষে মেলা, ইত্যাদি।

বাংলাদেশের কয়েকটি ঐতিহ্যবাহী মেলা

বাংলাদেশে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সময় মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে, যা আমাদের দেশের একটি ঐতিহ্যকে ফুটিয়ে তোলে। আমাদের দেশের উল্লেখযোগ্য মেলাগুলোর মধ্যে কিছু মেলা সম্পর্কে আমরা তুলে ধরলাম;

গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য ও মিলন মেলাgram banglar mela
গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য ও মিলন মেলা

ধামরাইয়ে রথের মেলা

ধামরাইয়ে রথের মেলা ঢাকা জেলার ধামরাই উপজেলায় প্রতি বছর রথযাত্রার দিন একটি অনুষ্ঠিত হয়। মেলার প্রধান আকর্ষন রথযাত্রার দিন একটি বিশাল রথে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা মূর্তি আরূঢ় করে শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়।

জব্বারের বলীখেলা

জব্বারের বলীখেলা চট্টগ্রামের লালদিঘী ময়দানে প্রতিবছর ১২ই বৈশাখে অনুষ্ঠিত হয়। এই খেলায় যারা অংশগ্রহন করেন তাদেরকে বলী বলা হয়। চট্টগ্রামের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর ১৯০৯ সালে এই খেলার সূচনা করেন। এই খেলাকে কেন্দ্র করেই  লালদিঘী ময়দানে বৈশাখী মেলার আয়োজন  করা হয়।

পোড়াদহ মেলা

বগুড়া জেলার ইছামতি নদীর তীরে পোড়াদহ নামক স্থানে প্রতি বছর এই মেলা বসে বলে এই মেলাকে পোড়াদহের মেলা বলা হয়। সমগ্র বাংলাদেশে যতো মেলার আয়োজন করা হয় তাদের মধ্যে পোড়াদহের মেলা অন্যতম। ধারনা করা হয় যে এই মেলাটি প্রায় ৪০০ বছর আগে সূচনা হয়। এই মেলার প্রধান আকর্ষন হচ্ছে মাছ। এই মেলায় প্রায় সকল প্রজাতির বড় বড় মাছ পওয়া যায়। এই মেলাকে কেন্দ্র করে এলাকার জামাইরা তাদের শশুর বাড়িতে বেড়াতে আসে এবং মেলা থেকে সামর্থ মত বড় বড় মাছ ক্রয় করে শশুর বাড়িতে যায়।

জামালপুরের জামাই মেলা

জামালপুর জেলার সদর উপজেলার ঘোড়াধাপ ইউনিয়নের গোপালপুর বাজারে প্রতিবছর চৈত্র মাসের ১-৩ তারিখ তিন দিন ব্যাপী এই মালা অনুষ্ঠিত হয়। ১৮০০-এর দশকে গোপালপুর বাজারে একটি বটবৃক্ষের নিচে বারুনি স্নান উপলক্ষে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা সেখানে একত্রিত হতো। সেখান থেকেই এই মেলার উৎপত্তি। পরবর্তিতে মুসলমানরাও এই মেলায় অংশগ্রহন শুরু করলে সকল ধর্ম ও বর্ণের মানুষের কাছে মেলাটি জনপ্রিয় হয়ে উঠে।

প্রতি বছরে এই মেলাকে কেন্দ্র করে এই এলাকার কয়েকটি ইউনিয়নের মানুষ তাদের মেয়ে ও জামাইকে বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে। মেয়েরা তাদের স্বামীদের নিয়ে মেলা উপলক্ষে পিতা-মাতার বাড়িতে আসেন। যার কারনে মেলাটির নাম জামাই মেলা নামে পরিচিতি লাভ করে।

লোক ও কারুশিল্প মেলা

নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে প্রতি বছর মাসব্যাপী আয়োজন করা হয় লোককারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসবের ৷ সোনারগাঁও লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন চত্বরে এ মেলা জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময় শুরু হয় ৷ বাংলাদেশের প্রায় সকল জেলা থেকে শিল্পীরা লোকজ সংস্কৃতি ও কুটির শিল্প সামগ্রী নিয়ে এই মেলায় উপস্থিত হন ৷

বৈশাখী মেলা

এটি মূলত বাংলাদেশের সার্বজনীন লোকজ মেলা ৷ বাংলা নতুন বছরকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্রই বৈশাখী মেলার আয়োজন করা হয় ৷ জেলা ও উপজেলা ভেদে বৈশাখ মাসের বিভিন্ন তারিখে এই মেলার আয়োজন করা হয়।

অমর একুশে গ্রন্থমেলা

বাঙ্গালি সংস্কৃতির মেলার একটি আধুনিক রুপ হচ্ছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। প্রতি বছর পুরো ফেব্রুয়ারি মাস ব্যাপী এই মেলা বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউজ প্রাঙ্গণে ও বর্ধমান হাউজ ঘিরে এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়।

পরিশেষ

গ্রাম প্রধান বাংলাদেশে মেলা শুধুমাত্র একটি অনুষ্ঠানের নাম নয়। বিভিন্ন উপলক্ষকে কেন্দ্র করে মেলা আয়োজন হলেও এটি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল জাত শ্রেনীর মানুষকে একত্রিত করে, সামাজিক ভেদাভেদ দূর করে নিজেদের মধ্যে সম্প্রিতি বৃদ্ধ করে। সাথে সাথে বিশ্ব দরবারে বাংলার সংস্কৃতিকে তুলে ধরে।

গ্রামের মেলা বাংলার ঐতিহ্য ও মিলন মেলা নিয়ে যদি আপনাদের যদি কোন প্রশ্ন থাকে তাহলে আপনি আমাদের প্রশ্ন করতে পারেন আমরা আপনাদের সাহায্য করবো আপনার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে।

আরও পড়ুন-

বাংলাদেশের সেরা ১০টি দর্শনীয় স্থান

সুস্থ জীবনের জন্য খেলাধুলার প্রয়োজনীয়তা

Leave a Comment