তুলসী পাতার উপকারিতা

তুলসী পাতার উপকারিতা

বাঙ্গালিদের ঘরে ঘরে এক সময় বেশ কিছু সাধারণ গাছের সমারোহ দেখা যেত। আমাদের দাদি-নানি থেকে শুরু করে মা, চাচী ও খালাদের ঘরের আঙ্গিনায় শোভা পেত অনেক রকমের ফুল,

ফল সহ একটি ঔষধি গাছ তার নাম হল তুলসি গাছ। এই তুলসী পাতার উপকারিতারয়েছে অনেক। এখনকার এই আধুনিক যুগে না আছে সেই সুন্দর পরিচ্ছন্ন আঙ্গিনা আর

না আছে কারোর তেমন গাছ রোপণের সদিচ্ছা। কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের সহজাত কিছু অভ্যাস। একটা সময় ছিল যখন, হরিতকি, পেয়ারা, আম, বহেরা, হিজল ও তুলসি গাছের মেলায় ভরে থাকতো আমাদের ঘরের উঠোন।

আজকের আলোচনার বিষয় তুলসি গাছ, তুলসী পাতার উপকারিতা এবং বাড়িতে যে যে কারণে তুলসি গাছ থাকা উচিত।  

অনেক অনেক গাছে ছেয়ে আছে বাড়ি, এই দৃশ্য আর উপভোগ করার সুযোগ নেই, মফস্বল ও গ্রামেও আজকাল শহুরে সব সুবিধা থাকার দরুন সেই প্রাকৃতিক আর স্বাভাবিক ব্যাপারগুলো উপভোগ করার উপায় নেই। ঋতুভেদে নানান গাছ রোপণ করার চলন ছিল কিন্তু সেইদিন আর অবশিষ্ট নেই। তুলসি গাছের উৎপত্তি মূলত এশিয়া মহাদেশে।

এই মহাদেশের কয়েকটি দেশ যেমনঃ বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, ইরান, নেপাল এবং থাইল্যান্ডের বেশিরভাগ জায়গায় এই গাছের দেখা পাওয়া যায়। বিভিন্ন গ্রীষ্মমন্ডলীয় এবং উপ-গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলের দিকে তুলসি গাছের ব্যাপক দেখা পাওয়া যায়। তুলসির উপকারিতার জন্যে এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিশ্বের অন্যান্য অনেক দেশেও এই গাছের চাষ ও রোপণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

তুলসি গাছের ইংরেজি ও বৈজ্ঞানিক নাম

তুলসি গাছের ইংরেজি নাম Basil Leaf এবং বৈজ্ঞানিক নাম Ocimum Basilicum (অসিমাম ব্যাসিলিকাম)। একে Sweet Basil ও বলা হয়। তুলসি পাতা পুদিনা পরিবার (Mint Family) এর মধ্যে অন্তর্ভূক্ত। 

তুলসি গাছের বৈশিষ্ট্য

প্রতিটি গাছের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য থাকে এবং প্রকৃতি, যত্ন ও পরিবেশভেদে গাছের বৈশিষ্ট্যে এবং ধরণে পরিবর্তন থাকতে পারে। তুলসি গাছের বৈশিষ্ট্য নিচে দেখানো হলোঃ 

  • তুলসি গাছ রোপণের আদর্শ সময় মার্চ ও এপ্রিল মাসে।
  • জুন থেকে সেপ্টেম্বর  মাসে এই গাছে ফুল আসা শুরু করে। 
  • এই গাছ রোদের মধ্যে বেশি বেড়ে ওঠে।
  • তুলসি গাছ পুদিনা পরিবার (Mind Family) বা ল্যামিয়াসিয়া (Lamiaceae)।
  • এই গাছের জন্যে সুনিষ্কাশিত এবং পুষ্টিসমৃদ্ধ মাঝারি পরিমাণে পানিসহ মাটির দরকার হয়ে থাকে।
  • তুলসির অনেক প্রকারভেদ রয়েছে যেমনঃ ফাইন-লিভড বেসিল (Fine-Leaved Basil), রেড লিভড বেসিল (Red-Leaved Basil), হারোপা (Haropa), সিনেমন বেসিল (Cinnamon Basil), আ্যনিস বেসিল (Anise Basil), নেপোলিটাম বেসিল (Nepolitan Basil), লেমন বেসিল (Lemon Basil)। 
  • তুলসি সাধারণত ২০ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার (৮-২৫ ইঞ্চি) পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে।
  • তুলসি গাছের পাতার রঙ গাঢ় সবুজ হয়। 
  • তুলসি পাতা ৬ সেন্টিমিটার (২.৩-৪ ইঞ্চি) পর্যন্ত লম্বা ও চওড়া হয়ে থাকে। 
  • গ্রীষ্মের সময়ে তুলসি গাছে অবশ্যই পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি দিতে হবে। 
  • তুলসি গাছ রোপণ করা শুরু করা উচিত একদম মার্চের শুরু থেকে। 
  • সূর্যের সংস্পর্শ রয়েছে, উষ্ণ অঞ্চলে এই গাছের ফলন ভালো হয়। 
  • তুলসি গাছের ফুলের রঙ হালকা থেকে গাঢ় বেগুনি রঙের হয়ে থাকে।

তুলসির উপাদানসমূহ

তুলসিতে বেশ কিছু রাসায়নিক ও উপকারী উপাদান রয়েছে। অনেক গবেষণার পর বেশ কিছু উপাদান থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে যথাঃ

মিথাইল সিনামেট  (৭০.১%)

লিলানুল  (১৭.৫%)

বি- এলেমেন (২.৬%)

কর্পূর (১.৫২%)

ক্যাম্ফোর (১.৫২%)

আরও রয়েছে ভিটামিন এ, ভিটামিন কে, আয়রণ, ম্যাঙ্গানিজ, এসেনশিয়াল অয়েল, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, বেটা-ক্রিপ্টোজ্যানথিন, জেয়াজেনথিন, লুটেইন, বেটা-কেরোটিন।

আরও পড়ুনঃ কালোজিরা ও রসুনের উপকারিতা

তুলসি গাছের ভেষজ গুণ

তুলসির গুণের কথা যুগে যুগেই আলোচনায় এসেছে তাই আজও আমরা তুলসী পাতার উপকারিতা জানার চেষ্টা করব।

  • তুলসি গাছে বেশ কিছু রাসায়নিক উপাদান রয়েছে যা ব্যাকটেরিয়া ও ফাংগাস ধ্বংস করে।
  • ত্বকের ইনফেকশনের জন্যে তুলসি পাতা বেশ কার্যকরী।
  • তুলসি সমৃদ্ধ টুথপেস্ট নিয়মিত ব্যবহারে মাড়ির স্বাস্থ্য ভালো থাকে। 
  • নিয়মিত তুলসির সেবন হজমের সমস্যা সমাধান করে।

তুলসি গাছের নানান ব্যবহার

  • বেশিরভাগ হিন্দুবাড়িতে তুলসি গাছ রাখার রেওয়াজ ছিল এবং এখনও রয়েছে। মূল বাড়ির ঠিক মধ্যখানে উঁচু বেদিতে সিমেন্টের সাহায্যে রোপণ করা হয়েছে সুন্দর ছিমছাম তুলসি গাছ- এমন দৃশ্য আমরা প্রায় সময়েই দেখে থাকি। সন্ধ্যা হলেই আলো জ্বেলে বাড়ির মহিলারা সিদুর পরনে, গায়ে আচল তুলে পিতল বা মাটির পাত্রে পানি ভরতি করে তুলসি গাছের চারপাশে মন্ত্র পড়তে পড়তে ঘুরে ঘুরে তুলসির গায়ে পানি ঢালা আমাদের বাংলার হিন্দু বাড়ির চিরাচরিত দৃশ্য। 
  • সাধারণ জ্বর, ঠান্ডা ও কাশির তীব্রতা কমাতে তুলসি পাতার রসের জুড়ি নেই। 
  • মুখের দাগের আধিক্য কমাতে তুলসির রস মাখলে আস্তে আস্তে সেই দাগের পরিমাণ কমে আসে।
  • অভিজাত রেস্তোরাঁয় খাবারের গারনিশ করতে বা স্বাদের আধিক্য বাড়াতে তুলসি পাতা ব্যবহার করে।
  • তুলসি পাতা দিয়ে চা বানিয়ে খেলে নানান ধরনের রোগের উপশম সম্ভব।
  • তুলসি গাছের শিকড় খেলে যৌন দুর্বলতা সেরে যায়।
  • সকালে সর্বপ্রথম পানির সাথে তুলসির রস মিশিয়ে খেলে হৃদরোগের উপকার পাওয়া যায়।

তুলসি গাছের গুনাগুণ ও উপকারিতা

তুলসি পাতার গুনাগুণ ও উপকারিতা

এখনও কিছু পরিবারে ডাক্তারের ওষুধের ওপর তেমন ভরসা করতে দেখা যায় না, পরিবারের সদস্যারা সবাইই প্রাকৃতিক উপাদানের উপর নির্ভরশীল। তুলসি এমন একটি গাছ যা হিন্দু বাড়ির শোভা বাড়িয়ে তুলত। এ তুলসী পাতার উপকারিতা দেখানো হলো।

  • যারা ব্রণের সমস্যা ও ব্রণের দাগের সমস্যায় ভুগছেন তারা নিয়মিত তুলসি পাতা বেটে মুখে ১০-১৫ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেললেই ব্রন ও ব্রণের দাগ সেরে যাবে।
  • দাদের সমস্যায় তুলসির রস মেখে দিলে ব্যাথা উপশম হয়।
  • নিয়মিত তুলসি পাতার রস খেলে মাংসপেশি ও হাড় ভালো থাকে।
  • নিয়মিত তুলসি পাতার রস খালি বা পানির সাথে মিশিয়ে খেলে রক্তের বিষাক্ত উপাদান হ্রাস পায়। 
  • গায়ের কোন অংশ পুড়ে গেলে সে স্থানে তুলসির রস লাগালে আরাম বোধ হয়।
  • নিয়মিত তুলসির সেবন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। 
  • ঘরের মধ্যে বিষাক্ত বাতাস থাকলে তুলসি গাছ তা সহজেই দূর করে দেয়।
  • নিয়মিত তুলসির সেবন কিডনির কার্যক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে।
  • তুলসি রক্তে ইউরিক এসিডের মাত্রা বাড়তে দেয় না।

বাড়িতে যে যে কারণে তুলসি গাছ থাকা উচিত

বাড়ির উঠানে বা বারান্দায় ছোট্ট একটি টবে তুলসি গাছ লাগিয়ে দিলে, মাঝে মাঝে নিড়িয়ে দিলে এবং প্রতিদিন নিয়ম করে সামান্য পানি দিলেই এই গাছ খুব দ্রুত বেড়ে উঠবে। বাড়িতে একটি তুলসি গাছ থাকলে সেই ঘরের এবং পরিবারের লোকেদের স্বাস্থ্যগত নানান সমস্যায় প্রচুর অর্থ খরচ না করেও তুলসি গাছের সাহায্য পরিপাকতন্ত্রের সমস্যা, ঠান্ডা-কাশি, হজমের সমস্যা ইত্যাদি ছোট ছোট অসুখ খুব দ্রুতই সেরে যাবে। 

তুলসি পাতা কি কাঁচা খাওয়া নিরাপদ?

তুলসিতে রয়েছে অধিক মাত্রায় আয়রণ ও পারদ যা সরাসরি চিবিয়ে খেলে দাঁতের ক্ষয় হতে পারে তাই তুলসি জ্বাল করে, রস করে,চা হিসেবে, তরকারিতে এবং পানির সাথে মিশিয়ে খাওয়া উত্তম। তুলসি অতিরিক্ত চিবোলে দাঁতের এনামেল নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। 

তুলসি গাছ কতদিন বাঁচে?

তুলসি গাছ সাধারণত ছয় থেকে আট মাস বেঁচে থাকে তবে যত্ন, আবহাওয়া, বৃষ্টিপাতভেদে তুলসি গাছের বেড়ে ওঠা অনেকাংশে নির্ভর করে।

সবশেষে বলা যায় যে প্রকৃতির কাছে আমরা নানান অর্থে ঋণী। প্রকৃতি আমাদের অনেক কিছুই দু’হাতে ভরে দিয়েছে আমাদের কেবল নেবার অপেক্ষা কিন্তু সঠিন নিয়ম না জানায় আমরা প্রকৃতির এই অমূল্য উপহারের মর্ম বুঝতে অক্ষম হই। আসুন প্রাকৃতিক উপাদানে স্বাস্থ্য রক্ষায় অভ্যাস করি। ডাক্তারের পরামর্শ অবশ্য জরুরি তবে সেই পরামর্শের পাশাপাশি অবশ্যই প্রাকৃতিক উপাদানের উপাকারের কথা মনে রাখা উচিত। 

আরও পড়ুন-

কালোজিরার উপকারিতা

আমলকির উপকারিতা ও অপকারিতা

Leave a Comment