ডুমুর ফল এর উপকারিতা

ডুমুর ফল এর উপকারিতা

ফলের রাজা আম হলেও হাজার রকম ফলের ভিড়ে আমরা ডুমুরের কথা কিন্তু ভুলে যাই নি। আজ ডুমুর ফলের উপকারিতা ও অপকারিতা নিয়ে জানব।

ডুমুর সুপ্রাচীন কাল থেকেই বহুল পছন্দীয় একটি ফল যার ব্যবহার বিশ্বায়নের ফলে দিন দিন বাড়ছে, পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই ডুমুরের চাহিদা রয়েছে।

তবে এই নানান রোগের সমাধান এই ঔষধি ফলের কথা অনেকেই পরিষ্কারভাবে জানে না। তাই আজকের আলোচনার বিষয় হবে ডুমুর ফল কি? ডুমুর ফল খাওয়ার নিয়ম? ডুমুর ফল এর উপকারিতা।

সঠিক নিয়ম মেনে না খেলে বা প্রয়োজনের অতিরিক্ত খেলে শারীরিক নানান জটিল সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। 

ডুমুর ফল কী?

ডুমুর একটি অতি উপকারি প্রাকৃতিক ও ভেষজগুণ সম্পন্ন ফল যার চর্চা হয়ে আসছে বহু বছর ধরে। এর ব্যবহার অনেকের সেভাবে জানা না থাকলেও গবেষণা ও পড়াশোনার সুবাদে এখন এই ফলের নানান উপকারের বিষয়ে অবগত। ডুমুর বাণিজ্যিকভাবে বেশ লাভজনক একটি ফল।

চাষাবাদ খানিকটা সময়সাপেক্ষ এবং কষ্টকর হওয়ায় দেশে ডুমুরের ফলন তেমন হয়ে ওঠে না তবে নানান পণ্যে ব্যবহারের কারণে বর্তমানে এর চাষাবাদ বা ফলন দিন দিন বাড়ছেই। ভিটামিনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ উৎস হতে পারে এই ডুমুর। নিয়মিত ডুমুরের ভক্ষণ সারিয়ে তুলতে পারে অনেক প্রকারের শারীরিক সমস্যা। 

ডুমুরের ইংরেজি ও বৈজ্ঞানিক নাম 

ডুমুরের ইংরেজি নাম Fig। বৈজ্ঞানিক নাম ফিকাস (Ficus)। ডুমুরের অনেক প্রকার হয়ে থাকে যেমনঃ এডরিয়াটিক ডুমুর, কালিময়রন, ব্ল্যাক মিশন, কডোটা, ব্রাউন টার্কি, ক্যাপরি ফিগস, সেলেস্ট ফিগস, বুরসা ফিগস ইত্যাদি। এই সব ডুমুরের মধ্যে সবচেয়ে সুমিষ্ট ডুমুরের নাম হলো বুরসা ফিগস। এই ডুমুরের বাইরের খোসা গাঢ় বেগুনী রঙয়ের হয় এবং ভেতরের অংশ লাল এবং বেগুনীর মিশেল। 

ডুমুর গাছের বৈশিষ্ট্য

প্রতিটি গাছের আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য হয়ে থাকে, আবহাওয়া, স্থান ও যত্নভেদে গাছের ফলন কেমন হবে সেটা নির্ভর করে। ডুমুর গাছের কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা নিচে দেখানো হলোঃ 

  • ডুমুর গাছ একটি দেহাতি ফল গাছ অর্থাৎ এই গাছটি গ্রাম বা পল্লীবাসিক একটি গাছ। আরও সহজ করে বলতে গেলে পাঁড়া গায়ে এই ফলের গাছের দেখা পাওয়া যায়। 
  • ডুমুর গাছ খুব দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
  • এই গাছ সাধারণত ৫০-৬০ বছর বেঁচে থাকে।
  • এই গাছের ফল নরম ও মিষ্টি প্রকৃতির হয়ে থাকে।
  • কিছু কিছু ডুমুর দেখতে বেগুনের মতো।
  • উষ্ণ জলবায়ু অঞ্চলে এই ধরনের গাছ বেশি দেখা যায়।
  • এই গাছ পাঁচ থেকে ছয় মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে।
  • এই গাছের ফল ত্বীন ফল নামেও পরিচিত। অনেক দেশে আঞ্জীর নামেও বেশ জনপ্রিয়।
  • বাংলাদেশে নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুতে সারা বছরই ডুমুরের চাষ হয়ে থাকে।
  • ডুমুর ফল অনেক রসালো ও বড় আকৃতির হয়ে থাকে।
  • প্রতিটি গাছে ৭০-৮০ টি  ফল হয়।
  • প্রতি বছর ফলের ফলনের পরিমাণ বাড়তে থাকে।
  • প্রতিটি পাতার গোড়ায় গোড়ায় ফল হবে।
  • কোন রাসায়নিক সার ছাড়াই জৈব সার ও কম্পোসড সার মিশিয়ে টবে লাগিয়ে ফল উৎপাদন করা যায়। 
  • নেমাটোড (Nematode) নামক পোকামাকড়ের দ্বারা ডুমুর গাছের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে। 

প্রতিটি ডুমুর ফল ওজনে ৮০ থেকে ১১০ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে।

আরও জানতেঃ পেয়ারা খাওয়ার উপকারিতা 

ডুমুর ফলের উপাদান

চিনির স্বাদ মেটাতে ডুমুর ফলের তুলনা হয়না কারন এই ফলটি বেশ মিশটি। এই ফলের উপাদানগুলো হলোঃ এমিনো এসিডস, মিনারেল, ভিটামিন, ক্যালরি ৭৪, ফাইবার (২.৯ গ্রাম), ক্যালসিয়াম(৬ %), ম্যাগনেসিয়াম(৮%), পটাশিয়াম (৭ %), আয়রণ (৬ %), জিঙ্ক, ভিটামিন কে, ভিটামিন বি ৬, প্রত্যেক ১০০ গ্রামে ০.৮ গ্রাম প্রোটিন রয়েছে এবং খুব স্বল্প পরিমাণে সোডিয়াম রয়েছে। 

ডুমুর রান্না করার পদ্ধতি

ডুমুর দিয়ে তৈরি অসাধারণ নিরামিষ অনায়াসেই আপনার ক্ষুদা নিবারণ করতে পারে, আসুন দেখে নিই ডুমুর দিয়ে তৈরি অসাধারণ সবজির রেসিপি। 

  • আধা কেজি ডুমুর ভালো করে পরিষ্কার করে ছোট ছোট করে কেটে পানিতে ভিজিয়ে এক পাশে রেখে দিতে হবে। 
  • একটি বাটিতে সামান্য হলুদ, মরিচ ও লবণের গুড়ো সামান্য পানি দিয়ে পেস্ট করে নিতে হবে। 
  • এরপর ছোট ছোট করে কেটে রাখা আলু সামান্য লবণ দিয়ে ভেজে নিতে হবে। 
  • একটি কড়াইতে সামান্য তেল, তেজ পাতা, দারুচিনি, এলাচ দিয়ে একটু গরম হলে মসলা আলু ও ডুমুর ঢেলে দিতে হবে এবং পরিমাণ মতো পানি দিয়ে সেদ্ধ করে নিয়ে কষাতে হবে। 
  • তৈরি হয়ে যাবে সুস্বাদু ডুমুরের তরকারি, গরম গরম পরিবেশন করুন ভাতের সাথে। 

ডুমুর ফল খাওয়ার নিয়ম

ডুমুর ফল খাওয়ার সবচেয়ে উত্তম নিয়ম হলো যদি ডুমুর সম্পূর্ণ পাকা অবস্থায় খাওয়া যায়। পাকা ডুমুর বদ হজম ও পাইলসের রোগের জন্যে মহাওষৌধ। ডুমুর শুকনো অবস্থায় খেলেও উপকারিতা কোন অংশে কমে যায় না তাই শুকনো অবস্থায়ও খাওয়া যায়। ডুমুরের তরকারি, ভর্তা ও আচার ছাড়াও খাদ্যাভাসে এর নানান ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। 

শুকনো ডুমুর কি স্বাস্থ্যের জন্যে ভালো?

পাকা ডুমুর দুর্লভ হলেও পাওয়া অসম্ভব নয় ঠিক সেভাবেই শুকনো ডুমুর যুগের চাহিদা অনুযায়ী বেশ সহজলভ্য হয়ে উঠেছে বাজারে। বিশেষ কিছু বাজারে এবং অনলাইনে শুকনো ডুমুরের বেশ চাহিদা রয়েছে। শুকনো ডুমুর কোষ্ঠ্যকাঠিন্য সারাতে অভিনবভাবে কার্যকরী প্রমাণিত হয়েছে।

শুকনো ডুমুর খাওয়ার সপ্তাহ খানেকের মধ্যে বেশ লক্ষণীয় পরিবর্তন দেখা যায়। কারণ শুকনো ডুমুরে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার আরোও রয়েছে ভিটামিন বি ৬ যা হজমের কাজ সহজ করার কাজে দুর্দান্ত সাহায্য করে। 

ইসলামে ডুমুরকে কি বলা হয়েছে

হাদিসে বর্ণিত রয়েছে যে আবু দারদার একবার দেখেছিলেন যে প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) কে এক জন ডুমুর হাদিয়া (উপহার) দিয়েছিলেন এবং নবী (সাঃ) সেই ডুমুরগুলো সবার মধ্যে বন্টন করে দিলেন এবং বললেন “ ইহা খাও কারণ এই ফল অনেক রোগ নিরাময় করে”।

ডুমুরকে বলা হয়ে থাকে বেহেশতী ফল এছাড়াও কুরআনে উল্লেখিত অনেক ফলের মধ্যে যেমনঃ জলপাই, খেজুর, কলা, আঙ্গুর ইত্যাদির মধ্যে ডুমুরের উল্লেখ রয়েছে।  সূরা আত-তীনে ডুমুরের কথা বলা হয়েছে।  

আরও জানতেঃ ডুমুর ফল এর উপকারিতা

ডুমুর ফলের উপকারিতা 

ডুমুর ফলের উপকারিতা ও অপকারিতা

প্রতিটি ফলের কোন না কোন পুষ্টিগুণ রয়েছে এবং ডুমুর ফলও এর বাইরে না। আমরা দেখে নেব ডুমুর ফলের উপকারিতা ও অপকারিতা এবং  ডুমুরের কি কি? উপকারিতা রয়েছে যথাঃ

  • যাদের ডায়েবেটিস রয়েছে তাদের জন্যে ডুমুর ফলের নিয়মিত ভক্ষন বেশ উপকারী কারণ ডুমুরে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার যা শরীরে ইনসুলিনের সমন্বয় ঠিক রাখতে সাহায্য করে।
  • যারা ডায়েটে আছে এবং চিনি ছাড়তে হিমশিম খাচ্ছে তারা সহজেই চিনির চাহিদা মেটাতে পাকা বা শুকনো ডুমুর খাওয়া যেতে পারে।
  • যেহেতু ডুমুরে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম রয়েছে তাই প্রস্রাবে বর্জ্য পদার্থের পরিমাণ কমাতে ডুমুর ফল সাহায্য করে।
  • শরীরের বিষাক্ত পদার্থ ডুমুর ফল ভক্ষণের দ্বারা প্রস্রাবের মাধ্যমে বের হয়ে যায়। 
  • যেহেতু ডুমুরে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম এবং স্বল্প পরিমাণে সোডিয়াম তাই ডুমুর উচ্চ রক্তচাপের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে।
  • পুরুষের বন্ধ্যাত্বের ঝুঁকি কমাতে ও শুক্রাণুর গণনা ( Sperm Count) বাড়াতে সাহায্য করে।
  • প্রাকৃতিকভাবে শরীরে টেস্টস্টোরনের পরিমাণ বাড়াতে ডুমুর ফলের ভক্ষণ সাহায্য করে। 
  • মস্তিষ্কের সঠিক চালনা ও বিকাশের জন্যে ডুমুরের তুলনা নেই।
  • সকালে সামান্য ২-৩ টি, এক মুঠো বাদাম ও কিছু শুকনো ডুমুর নিয়মিত খেলে শরীরের রক্তের পরিমাণ বাড়ে এবং তার সাথে সাথে বিপাক ক্রিয়াও (Metabolism)  বাড়ে।
  • ডুমুর নিয়মিত খেলে মাংসপেশীর ব্যাথা এবং ঘুমের সমস্যার সমাধান সম্ভব।
  • ডুমুর রক্তে খারাপ কোলেস্ট্রলের পরিমাণ বাড়তে দেয় না।
  • ক্যানসারের মতো মরণ ব্যাধির জীবাণুকে শরীর থেকে দূরে রাখতে ডুমুর সাহায্য করে।
  • ডুমুর ফলের ভেতরে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ছোট ছোট বীজ এবং এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে মিউসিন যা পেটের সমস্ত ময়লা একত্রে করে বের করে দেয়। 
  • ডুমুরে প্রচুর ফাইবার রয়েছে যা কোষ্ঠ্যকাঠিন্যর সমস্যা লাঘব করতে সাহায্য করবে।
  • ডুমুর ক্ষুদা নিবারণে সহায়তা করে। ২-৩ টি শুকনো ডুমুর বা ১-২ টি পাকা ডুমুর খেলে তাৎক্ষণিক ক্ষুদা কমে আসে।
  • ডুমুর পরিপাকতন্ত্রের সুষ্ঠভাবে কাজ করতে সাহায্য করে।
  • কঠিন ডায়রিয়ায় ডুমুর খেলে ডায়রিয়া সেরে যায়। 
  • ডুমুর শরীরে ফ্রি র‍্যাডিক্যাল তৈরি করতে সাহায্য করে। 
  • শরীরে জমে থাকা অতিরিক্ত মেদ কমাতে কার্যকরী। 
  • ডুমুরে রয়েছে ভিটামিন বি ৬ যা সেরোটোনিন তৈরি করে। 
  • শরীরের হাড় মজবুত করতে ডুমুরের নিয়মিত ভক্ষণ সাহায্য করে। 
  • ডুমুরের সাথে মেথি ও মধু মিশিয়ে খেলে হাঁপানি অনেকাংশে সেরে যায়। 
  • ডুমুর এন্টিওক্সিডেন্টের প্রধান উৎস হিসেবে বিবেচিত যার কারণে অনেক রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। 
  • হারানো যৌন শক্তি ফিরে পেতে ডুমুরের সেবন দারুন কার্যকরী।

ডুমুর ফলের অপকারিতা

  • ডুমুর যেহেতু প্রচণ্ড মিষ্টি খেতে একটি ফল, এর অধিক ভক্ষণ ডায়েবেটিস রোগিদের সুগার মাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণ হতে পারে। সামান্য খেলে সমস্যা নেই তবে অধিক খাওয়া এড়িয়ে যাওয়াই উচিত। 
  • যেহেতু মিষ্টি ফল তাই যারা ডায়েট করছে তারা বেশি ভক্ষণ করলে ওজন বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
  • ডুমুরে এলার্জি রয়েছে এমন লোকেদের ডুমুর খাওয়া বিপজ্জনক হতে পারে।
  • প্রাকৃতিক চিনি হিসেবে কাজ করায় অতিরিক্ত খেলে দাতের সমস্যা হতে পারে।
  • প্রয়োজনের অতিরিক্ত খেলে অন্ত্রে এবং পেটে বেদনা হতে পারে।
  • প্রয়োজনের অতিরিক্ত খেলে পেট স্ফীত দেখা যায়।
  • ডুমুরে খেলে লিভারের সমস্যা হতে পারে।
  • ডুমুরের অধিক ভক্ষণ রেটিনার রক্তপাত, পায়ুপথ প যোনি পথের রক্তপাতের কারণ হতে পারে।

শেষ কথা

উপরিউক্ত আলোচোনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, দেশের অনেক যুবক শিক্ষিত হয়ে বেকার অবস্থায় আছে, বেকারত্ব অনেক বড় অভিশাপ হয়ে আছে যুব সমাজের ওপর।  যথাযথ প্রশিক্ষণ নিয়ে এই সকল যুবকেরা ডুমুর গাছ ও ফলের চাষ করে খুবই লাভজনক ব্যবসায় পরিচালনা করতে পারে। এই আশ্চর্য উপকারী ফলের চাহিদা দিন দিন বাড়তে শুরু করেছে বিশ্ব বাজারে।

এই ফল দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশে রপ্তানি করার ফলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সফলতা লাভ করছে। এই ফলের বর্তমান নানান ব্যবহার লক্ষ্য করা যাচ্ছে তাই সেই ব্যবহারগুলোকে কাজে লাগিয়ে জুতসই পণ্য বাজারে আনতে পারলে অবশ্যই আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া এবং বেকারত্বের অভিশাপ ঘুচিয়ে দেওয়া সম্ভব।

তাই ডুমুর ফল এর উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে জানতে সম্পুর্ন পোস্ট মনোযোগ সহকারে পড়ুন। আপনার সুস্থতা কামনা করে আজকের মত এখানেই শেষ করছি ধন্যবাদ।

আরও পড়ুন-

লেবুর উপকারিতা

এলোভেরার উপকারিতা

Leave a Comment