অস্থিরতা দূর করার উপায়
জীবনে চলার পথে অস্থিরতা আমাদের নিত্য দিনের সঙ্গী। অস্থিরতা বোধ করেন না এমন মানুষ পাওয়া যাবে না, এমনকি ৫ বছরের শিশু যে তার মধ্যেও কাঙ্ক্ষিত বস্তু না পাওয়ার জন্যে অস্থিরতা দেখা দেয়। অস্থিরতা দূর করার উপায় না জানা থাকলেও এক ধরনের দুশ্চিন্তার উদ্ভব হয় যা মানসিক এক ধরনের পীড়া বোধ থেকে শুরু করে শারিরীক পীড়ার কারণও হতে পারে।
অস্থিরতাকে সঙ্গায়িত করতে হলে বলতে হবে এটি এমন একটি অনুভূতি যেখানে অস্বস্তি বোধ হয়, চিন্তা বা দুশ্চিন্তা হয় এবং প্রায় সময়ে ভয়ের সৃষ্টিও হয়। যেমনঃ আপনি কোন চাকরির পরিক্ষা দিতে যাচ্ছেন বা সরাসরি কোন ইন্টারভিউতে অংশ নিতে আপনাকে যেতে হচ্ছে এবং সেখানে কি হবে, কে কি জিজ্ঞেস করবে বা আপনাকে তাদের পছন্দ হবে নাকি যোগ্য প্রার্থী হিসেবে তা নিয়ে আপনার মধ্যে মানসিক পীড়া দেখা দিল, সেখান থেকেই চিন্তা, গা-হাত পা কাপা, প্রচুর ঘাম হওয়া ইত্যাদি হতে পারে।
অস্থিরতা কেন হয়
- ঘুমের সমস্যা।
- প্রচুর পানির পিপাসা।
- কোন কিছুতে মনোযোগ দেওয়ায় সমস্যা হয়।
- এক জাগায় স্থির হয়ে বসে থাকা যায় না।
- দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস।
- হাত- পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া।
- ঘাম ঝরা।
- খুব ভয়ের কিছু আশংকা করা।
- মানসিক ও শারীরিক অস্বস্তি বোধ করা।
- হৃদ স্পন্দন বেড়ে যাওয়া।
- মাথা ঘোরানো।
- মাংসপেশি শক্ত হয়ে যাওয়া।
- বমি বমি ভাব হওয়া।
- অশনী অনেক কিছু ভেবে ভয়ে চুপসে যাওয়া।
উপরের লক্ষণগুলো কমবেশি সকলের মধ্যেই দেখা যায়। শুনতে খুব সামান্য মনে হলেও Anxiety বা অস্থিরতা মানুষকে কাবু করে ফেলতে পারে মিনিটেই। অস্থিরতার দরুন হওয়া প্যানিক এটাকে (Panic Attack) আক্রান্ত হয়ে অনেকের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
বেশিরভাগ সময়ে অস্থিরতার পূর্ববর্তী কারন থাকে, হতে পারে সেটা শৈশবের ভয়ংকর কোন স্মৃতি যার পুনরাবৃত্তি দেখলে সেই ভয় ফিরে আসে আর মুহুর্তেই কাবু করে নেয়। শৈশবের ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা আমাদের পরবর্তী জীবনের সমস্যার কারণ হতে পারে।
আরও পড়ুনঃ উচ্চ রক্তচাপ কমানোর উপায়
ডিপ্রেশন কি এবং কেন হয়
১. পরিবারে পূর্বে কারো মানসিক সমস্যা বা অস্থিরতার সমস্যা
আপনার পূর্ব পুরুষ বা পরিবারের সদস্যদের মধ্যে যদি মানসিক সমস্যার নজির থেকে থাকে তাহলে পরবর্তীতে জন্ম নেওয়া সন্তানের মধ্যেও এই অস্থিরতার প্রকাশ ঘটতে পারে।
২.শৈশবে ঘটে যাওয়া যৌন হয়রানি
গবেষণায় দেখা গেছে যে, মেয়ে শিশুদের মধ্যে প্রতি ৯ জনের মধ্যে ১ জন এবং ছেলে শিশুদের প্রতি ৫৩ জনে ১ জন যৌন হয়রানির শিকার হয়। বেশিরভাগ সময়ে এসব যৌন হয়রানি করে থাকে পরিবারের লোকজন বা প্রাপ্তবয়স্ক কোন পুরুষ আত্নীয়। ১৬-১৯ বছর বয়সী মেয়েদের মধ্যে যৌন হয়রানির পরিমাণ বেশি। ৮২% যৌন হয়রানির শিকার হয় নারীরা যাদের বয়স ১৮ বছরের নিচে।
৩. নির্দিষ্ট ফোবিয়া
শতকরা ৩ থেকে ১৫% মানুষের মধ্যে নানান ধরনের ফোবিয়া দেখা যায়। ফোবিয়া বলতে নির্দিষ্ট কোন কিছুকে ঘিরে তীব্র ভীতির সঞ্চার হওয়াকে বোঝায়। হতে পারে সেটা বিভিন্ন বিষয় সংক্রান্ত যেমন- উচ্চতা, খাদ্য, প্রাণী, মাকড়সা, অন্ধকার, বদ্ধ জায়াগা, লোকজনের ভীর ইত্যাদি।
৪. দলছুট বা আলাদা হয়ে যাওয়ার ভয়
একাকিত্ব অনেক বড় সমস্যার কারন হতে পারে। একা থাকার ভয় বা হারিয়ে ফেলার ভয়কেই দলছুট বা সেপারেশন এনজাইটি (Separation Anxiety) বলে।
৫. কাছের কাউকে হারিয়ে ফেলা
জীবন যেখানে আছে সেখানে মৃত্যু অবধারিত। কোন দূর্ঘটনা, রোগ অথবা বার্ধক্যজনিত কারনে কাউকে না কাউকে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতেই হয়। যখন খুব কাছের কেউ আমাদের ছেড়ে চলে যায় তখন আমাদের সে পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়াতে সমস্যার সৃষ্টি হয়, সেই মানুষটিকে ছাড়া কিভাবে বাঁচা সম্ভব সে উপায় আমাদের জানা থাকে না।
এছাড়াও আমাদের বেড়ে ওঠা, পারিবারিক সমস্যা, অসুস্থতা, জীবনে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনার ওপর আমাদের অস্থিরতার ধরন ও সময় নির্ভর করে।
আরও পড়ুনঃ হার্টের সমস্যার লক্ষণ ও প্রতিকার
দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তির ঔষধ
নানান কারণেই আমরা অস্থিরতায় ভুগি। মাঝে মাঝে অস্থিরতায় ভোগা স্বাভাবিক। তবে যদি শারীরিক এবং মানসিক অবস্থা ধীরে ধীরে চরমে পৌঁছে যায়, তাহলে বিষয়টি ভাবনার ব্যাপার। মনোচিকিৎসকরা বলেন, অস্থিরতাকে বাড়তে দেওয়া উচিত নয়। স্বাভাবিক অস্থিরতাই এক সময় অস্বাভাবিক হয়ে দেখা দিতে পারে। নিচে অস্থিরতা দূর করার কিছু উপায় উল্লেখ করা হলঃ
১. মন খুলে কথা বলা
নিজের কষ্টের কথা কাউকে বলতে পারার মধ্যে অনেক কিছু নির্ভর করে। হতে পারে সে কাছের কোন বন্ধু, পরিবারের সদস্য বা সিনিয়র কোন কলিগ। যদি অস্থিরতার সমস্যা খুব বেশি গুরুতর হয়ে থাকে সেক্ষত্রে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরী। একজন শিক্ষিত,আন্তরিক সাইকাট্রিস্ট যেভাবে আপনার কথা শুনে,পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে সমাধান দেবেন সেভাবে অন্য কেউ পারবে না। অবশ্যই ভালো ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পন্ন, আগে কাজ করেছে এমন ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা উচিত।
২. ব্যায়াম
ব্যায়াম করার ফলে শরীর থেকে প্রচুর ঘাম ঝরে। ব্যায়ামের দ্বারা Feel-Good Endrophins নিঃসৃত হয় এবং যা সুস্থতার বোধকে জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করে। ২০-৩০ মিনিটে হাটা, এরোবিকস, কার্ডিও বা হিট এক্সারসাইজ আপনার অস্থিরতা কমিয়ে ধৈর্য বাড়াতে সাহায্য করবে।
৩. শ্বাস প্রশ্বাসের ব্যায়াম
জোরে জোরে ও সঠিক নিয়মে শ্বাসের ব্যায়াম করার ফলে শরীরে বাতাস প্রবাহিত হয় যা স্নায়ুকে শান্ত করতে ও উদ্বেগ কমাতে সাহায্য করে। এ ছাড়াও মনোযোগ বাড়াতে, অস্বস্তি কমাতে বেশ কার্যকর।
৪. প্রার্থনা
আমরা যে ধর্মেরই হই না কেন আমাদের সবারই প্রার্থনার সুযোগ থাকে। দিনের কিছু সময় বের করে স্রষ্টার আরাধনায় ব্যয় করলে জীবনের পাপ পূণ্যের খেয়াল আসে, স্রষ্টার বিশালতার কাছে নিজেকে অতি ক্ষুদ্র ও তুচ্ছতম মনে হয়। এতে মনে প্রশান্তি ও আত্নতৃপ্তি আসে।
৫. বই পড়া
গবেষণায় দেখা গেছে যে প্রতিদিন যে ছয় মিনিট বই পড়ে তার মানসিক অস্থিরতা অনেক কমে আসে, জ্ঞানের পরিধি বাড়ে, উচ্চ হৃদস্পন্দন কমে আসে, দুশ্চিন্তা কমাতে ও মাংসপেশি সচল করতেও সহজ করতে সাহায্য করে। সহজ ও ইতিবাচকভাবে চিন্তা করতে বই উদ্বুদ্ধ করে, ঘুমাতে সহায়তা করে, মানুষের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনের ক্ষমতা দেয়।
৬. আ্যলকোহল/ মাদক সেবন থেকে দূরে থাকা
মদ্যপান ও মাদকসেবনে নিয়মিত হলে অস্থিরতার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। আ্যলকোহল মস্তিষ্কের রসায়নে প্রভাব ফেলে, আতঙ্কের সৃষ্টি করতে পারে। মৃদুমদ্যপান মস্তিষ্কের শিথিলভাব আনতে পারে কিন্তু ভারী মদ্যপান মস্তিষ্কে উন্মাদনা ও উত্তেজনার অনুভূতি বৃদ্ধি করে। তাই অস্থিরভাব কমাতে মদ ও মাদক থেকে দূরে থাকতে হবে।
৭. পর্যাপ্ত ঘুম
একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের প্রতিদিন ৭-৮ ঘন্টা করে ঘুম প্রয়োজন। প্রশান্তি ও ক্লান্ত শরীরের ঘুম রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, কাজের গতি বাড়ায়, কাজের মান উন্নয়ন করে, হৃদরোগের কার্যকারিতা বাড়ায়, অস্থিরতা কমিয়ে মনকে স্থির করতে প্রলুব্ধ করে।
৮. ক্যাফেইন সেবন কমানো
যদি অতিরিক্ত অস্থিরতা থাকে তাহলে ক্যাফেইনের সেবন কমানো উচিত। ক্যাফেইন ঘাবড়ানো ও উদ্বিগ্নতার পরিমাণ বাড়াতে পারে, সেক্ষেত্রে অতিরিক্ত ক্যাফেইন সেবন কমানো উচিত।
৯. দূরে কোথাও ঘুরতে যাওয়া
সময় করে দূরে প্রিয়জনের সাথে ঘুরে বেড়ালে মনে প্রানবন্ত ভাব আসে আর ধীরে ধীরে অস্থিরতা কমে আসে।
১০. সমাজসেবা করা
মানুষ মানুষের উপকারে আসবে এই শিক্ষাই মনে মেনে চলা উচিত। আমরা যারা সুবিধাপ্রাপ্ত তারা সুবিধাবঞ্চিতদেরকে সুযোগ ও সামর্থ্যমত সাহায্য করতে পারি। এতে আমাদের মানসিক প্রশান্তি বিরাজ করবে এবং অস্থিরতা কমে আসবে।
শেষ কথা
পরিশেষে বলা যায় যে, অস্থিরতা আমাদের কাজের গতি কমাতে পারে এবং সর্বোপরি স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর। সর্বপ্রথম আমাদের শনাক্ত করতে হবে অস্থিরতা দূর করার উপায় আর সেইমত চিকিৎসা বা ব্যবস্থা নিতে হবে। সুস্থতা আমাদের সকলের কাম্য, আমরা অস্থিরতার জন্যে কখনোই জীবনে পিছিয়ে পরতে চাই না, আমরা বাধহীনভাবে এগিয়ে যেতে চাই।