অনলাইনে খতিয়ান দেখার নিয়ম
আজ আমাদের মূল আলোচনার বিষয় অনলাইনে খতিয়ান দেখার নিয়ম। খতিয়ান দেখার নিয়ম জানার আগে অবশ্যই আপনাকে জানতে হবে খতিয়ান বা পর্চা কি? খতিয়ান ও পর্চা কি একি? খতিয়ান পর্চা সম্পর্কে সম্পূর্ণ ধারণা দিতে এবং অনলাইনে কিভাবে আপনি খতিয়ান দেখতে পারবেন এবং সেই সাথে যুক্ত খুঁটিনাটি সকল বিষয় জানাতে আজ আপনার সাথে আছি আমরা।
খতিয়ান বা পর্চা কি?
জমির আসল মালিকানা কে বা কারা তার বর্ণনা প্রস্তুত করা কেই বলা হয় জমির খতিয়ান, এই খতিয়ান প্রস্তুত করা হয় ভূমি অধিদপ্তর এর রেকর্ড ও জরিপ অনুযায়ী। বাংলাদেশের সকল জমির রেকর্ড সংগ্রহ করা আছে ভূমি অধিদপ্তর এর নিকট। ভূমির যাবতীয় লেনদেন লিপিবদ্ধ করাই খতিয়ান বা নোটখাতা ও বলা যায়। জমির মালিকানা নির্ধারনে ব্যবহৃত যাবতীয় তথ্যাবলী একত্রিত বিবরণীকে জমির খতিয়ান বলা হয়।
আরও পড়ুনঃ ডিজিটাল মার্কেটিং শেখার উপায়
খতিয়ান এর প্রকারভেদ কি কি?
শুরু থেকে এখন পর্যন্ত খতিয়ান চার ধরনের হয়ে থাকে, ব্রিটিশ আমল থেকে এটি শুরু হয়েছে বলে জানা যায়।
সি.এস খতিয়ান (CS Khatian)(১৮৮৭-১৯৪০)
মূলত ব্রিটিশ শাসনামলে শুরু হয় সি এস খতিয়ান। এটি উপমহাদেশের প্রথম খতিয়ান নামেও পরিচিত। এই খতিয়ান ব্রিটিশদের তৈরি এবং তখন কার সময়ে এই খতিয়ান টি ব্যবহার করা হতো। এই খতিয়ান লম্বালম্বি ভাবে এবং দুই পৃষ্ঠা জুড়ে করা হয় যা দেখে সহজেই বোঝা যায় এটি সি এস খতিয়ান কিনা। যার উপরের দিকে থাকে বাংলাদেশের ফরম নাম্বার এবং শুরুতেই থাকে জমিদার এবং প্রজার নাম।
এস.এ খতিয়ান (SA Khatian) (১৯৫০)
এস এ খতিয়ান শুরু হয় মূলত ব্রিটিশ শাসনামলের শেষের দিকে যখন পাকিস্তান শাসন আমল শুরু হয় তখন আবার নতুন করে খতিয়ান তৈরি করতে হয়। আর সেই খতিয়ানের নাম দেওয়া হয় এস এ খতিয়ান।১৯৫০ সাল থেকে মূলত এই খতিয়ান কার্যকর হয়। এ খতিয়ানের কিছুটা ভুল ত্রুটি লক্ষ করা যায় কারণ এই খতিয়ান করতে সরকারি কর্মজীবী দের সরোজমিনে না গিয়ে অফিসে বসেই খতিয়ান তৈরি করা হতো।
আর এজন্যেই খতিয়ান অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে অনেক অসমতা লক্ষ্য করা গিয়েছে। এস এ খতিয়ান পরীক্ষা করলে দেখা যায়, এই খতিয়ানটি এক পৃষ্ঠার হয় এবং এই খতিয়ানটি হাত দিয়ে লেখা হয়। এস এ খতিয়ান চেনার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো খতিয়ানটি হাতে লেখা।
আর.এস খতিয়ান (RS Khatian)
উপরের উল্লেখিত দুটি খতিয়ান একটি ব্রিটিশের তৈরি অন্যটি পাকিস্থানীদের তৈরি হলেও দুটি খতিয়ান এর মধ্যে বেশ কিছু ভুল লক্ষণীয় হয়। যার কারণে পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকার এইসকল খতিয়ানের ভুল ত্রুটি সংশোধন করে নতুন খতিয়ান প্রকাশ করেন যার নাম আর এস খতিয়ান।
এই খতিয়ান চেনার সহজ উপায় হলো, এই খতিয়ান সি এস খতিয়ান এর মত লম্বালম্বি হয়। তবে এই খতিয়ান সি এস খতিয়ান এর মত হয় না, এক পেজ এ সম্পন্ন করা হয় এবং রেসার্তে নাম্বার লিখা থাকে একেবারে ডান পাশে।
বি.এস খতিয়ান (BS Khatian) (১৯৯৯)
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রচলিত জরিপে প্রাপ্ত খতিয়ান এর সর্বশেষ হল বি এস খতিয়ান যা শুরু হয়েছে ১৯৯৯ সাল থেকে। মহানগরীর ঢাকার জরিপ হিসাবেই এই খতিয়ান পরিচিত। বিএস খতিয়ানে মূলত কলাম থাকে ৯ টি সেখানে তথ্য দেওয়া থাকে জরিপ কি ধরনের হবে।
জমির খতিয়ান ও পর্চা কি একই?
অনলাইনে জমির খতিয়ান বের করার নিয়ম জানার আগে আপনাকে বুঝতে হবে খতিয়ান কি। এতে করে আপনার উদ্দেশ্য এবং মূল বিষয়টি বুঝতে পারা অনেক সহজ হয়ে যাবে।
এককথায় বলা যায় খতিয়ান মানে হল হিসাব নিকাশ এর একত্রিত করা বিস্তারিত তথ্য। তবে যখন বিষয়টি জমির ক্ষেত্রে হয় তখন একে বলা হয় পর্চা। কে জমির মালিক তার সঠিক প্রমাণ হিসেবে সরকারের নিকট যে কাগজপত্র জমা থাকে তাকে বলা হয় পর্চা। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই নামের পরিবর্তন হতে পারে।
আরও পড়ুনঃ ঘরে বসে অনলাইনে টাকা ইনকাম
কেন প্রয়োজন জমির খতিয়ান চেক করা?
অনেক সময় দেখা যায় জমি জমার ক্ষেত্রে অনেকেই প্রতারিত হন। এই প্রতারণার হাত থেকে বাঁচতে এই জমির খতিয়ান চেক করে জমি ক্রয় করা উচিত। আপনি যখন জমির খতিয়ান চেক করবেন তখন আপনি জানতে পারবেন আসল জমির মালিক কে। যার কাছ থেকে জমি কিনছেন সেই কি জমির আসল মালিক। এবং জমি সংক্রান্ত বিভিন্ন খুঁটিনাটি সকল বিষয় আপনি জানতে পারবেন। জমির সঠিক পরিমাণ ঠিক করা এবং জমি বন্টনের ক্ষেত্রে ও খতিয়ান দেখে করা হয়। আবার জমি ওয়ারিশ প্রাপ্ত কিনা, সে বিষয়ে জানতে ও জমির খতিয়ান দেখার প্রয়োজন।
যা কিছু উল্লেখ থাকে খতিয়ান ও দাগের তথ্য অনুসন্ধান বিবরণীতে
- প্রথমেই থাকে জমির মালিকের নাম, পিতার নাম এবং ঠিকানা
- জমির সীমানা, জমির পরিমাণ, জমির অবস্থান
- এস্টেটের মালিকের নাম,এস্টেটের মালিকের ঠিকানা, এস্টেটের মালিকের পিতার
- নাম বিধি ২৮,২৯,৩০ মোতাবেক খতিয়ান তৈরীর সময় খাজনার পরিমাণ
- খাজনা বৃদ্ধিক্রম এর বর্ণনা এবং খাজনা নির্ধারণ পদ্ধতি
- অন্যান্য সকল অধিকার সমূহ যেমন পথের অধিকার
- যদি জমি নিজের হয় সে ক্ষেত্রে তার বিবরণ
- এরিয়া নাম্বার,বাট্রা নাম্বার, জে এল নাম্বার, দাগ নাম্বার, মৌজা নাম্বার, খতিয়ান নাম্বার
জমির খতিয়ান বের করার প্রচলিত নিয়ম
সাধারণত দুইটি নিয়মে জমির খতিয়ান বের করা যায়। যারা জমি সংক্রান্ত বিষয় জড়িত মূলত তারা এই দুটি নিয়ম অনুসরণ করেই খতিয়ান বের করেন। চলুন বিষয়গুলো সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
এলাকার নির্দিষ্ট ভূমি অফিসের মাধ্যমে খতিয়ান চেক
আপনাকে প্রথমে যেতে হবে আপনার এলাকার অথবা যে এলাকায় আপনার ভূমি, অথবা আপনি যে এলাকার ভূমি ক্রয় করতে চান সেই এলাকার ভূমি অফিসে। ভূমি অফিসে আপনাকে জমি বা ভূমির খতিয়ান নাম্বার এর ভলিউম চেক করতে হবে। যদি দেখেন খতিয়ান নাম্বার এর ভলিউমের মিল আছে তাহলে বুঝে নিবেন খতিয়ানে কোন সমস্যা নেই। অন্যথা যদি দেখেন খতিয়ান নাম্বার এর কোন মিল নেই তাহলেই বুঝে নেবেন আপনি প্রতারিত হয়েছেন।
অনলাইনে খতিয়ান দেখার নিয়ম
তুলনামূলক ভাবে সবথেকে সুবিধাজনক এবং সহজ উপায় হল অনলাইনে খতিয়ান দেখা।
আপনি অনায়াসে ঘরে বসেই একটি স্মার্টফোনের মাধ্যমেও খুব সহজ উপায় অনলাইনে খতিয়ান দেখে নিতে পারবেন। এই জন্য আপনাদের যে পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে তা একে একে বলে দিচ্ছি।
- প্রথমে প্রবেশ করতে হবে ভূমি অফিসের ওয়েবসাইটে। খতিয়ান বের করার লিংক (https://eporcha.gov.bd/khatian-search-panel) এ ক্লিক করে পেজ টিতে প্রবেশ করবেন।
- পেজ টিতে প্রবেশ করার পর প্রথমেই আপনাকে বাছাই করতে হবে আপনার বিভাগ জেলা ও খতিয়ানের ধরন। এরপরে থাকবে- উপজেলা, দাগ নাম্বার, মালিকানা নাম, মৌজা, খতিয়ান নাম্বার, পিতা/ স্বামীর নাম সেখানে উল্লেখ করতে হবে।
- এরপর আপনার ক্যাপচার এ থাকা কোর্ট নাম্বার টি সঠিকভাবে দিয়ে দিন। খুব সাবধানের সাথে কাজটি করবেন যাতে কোনো ভাবেই ভুল না হয়। এখন লিখা আসবে ‘অনুসন্ধান করুন’ এই বাটনে ক্লিক করলেই জমির খতিয়ান দেখতে পারবেন।
এছাড়াও অনলাইন ব্যবস্থায় আরও যেসব সুবিধা রয়েছে যেমন সার্টিফাইড কপি জন্য আবেদন, ট্রাকিং ব্যবস্থা আবেদন নিস্পত্তি বিষয়ে, মনিটরিং করার সুবিধা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক।আপনি যদি অনলাইনে খতিয়ান এর কপি পেতে চান তাহলে আবেদনের সময় জাতীয়পরিচয় পত্র নাম্বার, নাগরিকের নাম ও ফোন নাম্বার ইত্যাদি আরো বিভিন্ন তথ্য দিয়ে ফরম ফিলাপ করতে হবে। সকল তথ্য দেওয়া সম্পূর্ণ হলে আপনি যেকোন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে খতিয়ান দেখার নির্ধারিত ফি পরিশোধ করতে হবে। এই সকল কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়ার পরে আপনি চাইলে আপনার খতিয়ান প্রিন্ট করে নিতে পারবেন।
সার্টিফাইড কপি যদি পেতে চান সে ক্ষেত্রে ফোন নাম্বার পরিচয় পত্র নাম্বার নাগরিকের নাম ইত্যাদি বিভিন্ন তথ্য আবেদন করার সময় দিতে হবে। আবেদন করার জন্য আপনার মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে বিল পরিশোধ করতে হবে। ফি জমা দেওয়া হয়ে গেলে সার্টিফাইড কপি পাওয়ার জন্য পুনরায় ইমেইল নাম্বার মোবাইল নাম্বার ডাকযোগ ঠিকানা জাতীয় পরিচয় পত্র ট্রানজেকশন আইডি সবকিছু ঠিক ভাবে পূরণ করে অনলাইনে আবেদন করতে পারবেন। সংশ্লিষ্ট জেলা অফিস থেকে অথবা আপনার প্রত্যাশিত ঠিকানায় নির্দিষ্ট দিনে ডাক যোগের মাধ্যমে আর এস খতিয়ান সার্টিফাইড কপি আপনাকে প্রদান করা হবে।
শেষ কথা
মানুষের জীবনে অতি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হল জমি-জমা। আর তাই এটি ক্রয় করার সময় বিভিন্ন সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। সব সময় জমি ক্রয় করার ক্ষেত্রে জমির মালিকানা যাচাই এর জন্য জমির খতিয়ান চেক করে নেবেন।
আজ আমরা অনলাইনে খতিয়ান দেখার নিয়ম এবং সেই বিষয়ে সমস্ত খুঁটিনাটি তথ্য গুলো আপনাদের সামনে বিস্তারিত ভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আশা করি আমাদের তথ্যগুলো আপনাদের ভালো লেগেছে। যদি আমাদের তথ্য আপনাদের ভালো লেগে থাকে তাহলে ছোট্ট করে কমেন্ট সেকশনে কিছু লিখে আমাদের উৎসাহিত করতে পারেন, নতুন নতুন আরো সুন্দর আর্টিকেল আপনাকে উপহার দেওয়ার জন্য।
আরও পড়ুন-
অনলাইনে বিমানের টিকেট কাটার নিয়ম
অনলাইনে ট্রেনের টিকেট কাটার নিয়ম