অনিয়মিত মাসিকের কারণ, প্রতিকার, লক্ষণ ও চিকিৎস

অনিয়মিত মাসিকের কারণ

সাধারণত ২৮ দিন পরপর বা ১ মাস পরপর প্রতিটি সুস্থ নারীর মাসিক হয়ে থাকে। মাসিক চক্রের এই মেয়াদ অনেক সময় ব্যাক্তির স্বাস্থ্যভেদে ৩৫ দিন পর্যন্তও হতে পারে। যদি এক সপ্তাহের বেশি দেরিতে শুরু হয় তবে তাকে অনিয়মিত বলা যায়। এই অনিয়মিত পিরিয়ডকে বলা হয় অলিগমেনরিয়া যা নারীদের একটি সাধারন সমস্যা।

তবে এর চাইতে যদি এই মেয়াদ অনেক বেশি হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে এবং লাইফস্টাইলে আনতে হবে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন। 

চলুন তবে সতর্কতার অংশ হিসাবে অনিয়মিত মাসিকের কারণ, লক্ষ্মণ, রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা, টিপস এবং সম্পর্কিত বেশ কিছু সচরাচর জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করি। 

আরও পড়ুনঃ মাসিক বন্ধ হলে কি করতে হবে ও চিকিৎসা পদ্ধতি

অনিয়মিত হবার কারণসমুহ

অনিয়মিত মাসিকের কারণ

শুরুতেই বলে রাখি অনিয়মিত মাসিক হওয়া সাধারণ ব্যাপার। মেয়েদের মাসিক সাধারণত প্রতি ২৮ দিন পরপর হয় এবং মাসিকচক্র স্থায়ী হয় ২১ থেকে ৩৫ দিনের মধ্যে। 

আর যদি কোনো নারীর মাসিকের ক্ষেত্রে এমন স্বাভাবিক অবস্থা দেখা না যায় সেক্ষেত্রে ধরে নেওয়া হয় তার অনিয়মিত মাসিক দেখা দিয়ে। এই অনিয়মিত মাসিকের সমস্যা দেখা দেওয়ার আবার বিভিন্ন কারণও রয়েছে। 

এসব কারণের মাঝে গর্ভনিরোধক বিশেষ করে অন্তঃসত্ত্বা না হওয়ার ঔষধের ব্যবহার, বয়ঃসন্ধিকালের সমস্যা, পেরিমেনোপজ এবং বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় দেখা দেওয়া বিভিন্ন পরিবর্তন অন্যতম। 

তাছাড়া অনিয়ন্ত্রিত লাইফস্টাইল ফলো করলেও এই ধরণের সমস্যা দেখা দিতে পারে। চলুন এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানি: 

গর্ভধারণ

কোনো নারীর পিরিয়ড মিস হওয়া বা অনিয়মিত মাসিকের অন্যতম কারণ হলো গর্ভাবস্থা। এছাড়াও IUD নামক হরমোনজনিত জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি, প্যাচ, ইমপ্লান্ট এবং অন্যান্য গর্ভধারণ রিলেটেড জিনিসপত্রের জন্যেও মাসিক মিস হতে পারে। 

বুকের দুধ খাওয়ানো

অনিয়মিত মাসিকের কারণ হলো বুকের দুধ খাওয়ানো। মূলত প্রোল্যাক্টিন নামের এমন একটি হরমোন রয়েছে যা মায়ের দুধ উৎপাদনে ভূমিকা পালন করে। 

সুতরাং শিশুর জীবনের প্রথম মাসগুলিতে যারা অনেক বেশি পরিমাণে স্তন্যপান করান তাদের এই হরমোন বেশি পরিমাণে উৎপন্ন হতে পারে। 

ফলে অনিয়মিত হতে পারে মাসিক। বলে রাখা ভালো এই রোগটিকে সাধারণত ল্যাকটেশনাল অ্যামেনোরিয়া বলে। 

পেরিমেনোপজ

পেরিমেনোপজ হলো প্রতিটি নারীর বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি সময়। সাধারণত ৪০ বছর বয়সী নারীদের মাঝে এই বিশেষ সময়টি শুরু হয়। প্রতিটি নারীকেই ৪০ থেকে ৪৮ বছরের মধ্যে এই সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। 

আর এই সময়টাতে মাসিক চক্র বিভিন্ন সময়ে দীর্ঘ বা ছোট হতে পারে। শেষের দিকে মাসিক চক্রের সময় বাড়তে বাড়তে একটা সময়ে গিয়ে তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে। 

মানসিক চাপ 

আপনি যদি অনেক দিন অনেক খুব বেশি মানসিক চাপে ভোগেন সেক্ষেত্রে আপনার অনিয়মিত মাসিকের সমস্যা দেখা দিতে পারে। যখন কোনো ব্যাক্তি অনেক বেশি মানসিক চাপে থাকে তখন তার শরীর স্ট্রেস হরমোন নিঃসরণ করে। 

আর এসব হরমোনের মাঝে অ্যাড্রেনালিন এবং কর্টিসল নামক দু’টো গুরুত্বপূর্ণ হরমোন রয়েছে। যেসব হরমোন সরাসরি যৌন হরমোনের সাথে কানেক্টেড। যার কারণে মানসিক চিন্তাগ্রস্ত নারীদের মাঝে মাসিক নিয়মিত না হওয়ার সমস্যা মাত্রাতিরিক্তভাবে দেখা দিতে পারে। 

পলিসিস্টিক ডিম্বাশয় সিন্ড্রোম

পলিসিস্টিক ডিম্বাশয় সিন্ড্রোম হলো ডিম্বাশয়ে সিস্ট বেড়ে যাওয়া। এই সিন্ড্রোমের কারণে নারীদেহে উচ্চ মাত্রার এন্ড্রোজেন দেখা দেয়। 

ফলে ডিম্বাশয়ের মুখ বন্ধ হয়ে মাসিক অনিয়মিত হতে থাকে। পাশাপাশি এই ধরণের রোগীদের যতবারই মাসিক হয় ততবারই অতিরিক্ত পরিমাণে রক্তপাত হতে থাকে। 

থাইরয়েডের সমস্যা

অনেকসময় থাইরয়েডের সমস্যার কারণেও মাসিক মিস হতে পারে। রেডিওথেরাপি, বা থাইরয়েডের অংশ সার্জারি করে ফেলে দিতে পারলে এই ধরণের সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। 

অনিয়মিত মাসিকের লক্ষ্মণ 

অনিয়মিত মাসিকের কারণ জানার পাশাপাশি আপনাকে বুঝতে হবে কখন আপনার মাসিক অনিয়মিত হচ্ছে বা এই ধরণের সমস্যা বোঝার লক্ষ্মণগুলি কি কি। এক্ষেত্রে নিচের পয়েন্টগুলিতে ফোকাস করতে পারেন:

  • পরপর ৩ মাস পিরিয়ড মিস করা
  • ২১ দিনের মধ্যেই ২ বার পিরিয়ডের ডেট পড়া
  • অনেক বেশি বা কম পরিমাণে ব্লিডিং হওয়া
  • পিরিয়ডের ডেটে প্রতিবার ৯ দিনের বেশি তারতম্য থাকা
  • পিরিয়ডের সময় প্রচণ্ড ব্যথা, ক্র্যাম্পিং, বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া
  • এক ঘন্টার মধ্যে এক বা একাধিক ট্যাম্পন বা স্যানিটারি প্যাড ব্যবহারের প্রয়োজন পড়া

মনে রাখবেন, মাসিক চক্র সবসময় অনুমানযোগ্য নাও হতে পারে! তাছাড়া কিছুটা সময়ের পরিবর্তন দেখা দিতেই পারে৷ এই ধরণের মাসিক অনিয়মকে স্বাভাবিকভাবে ধরে নিতে পারেন। 

রোগ নির্ণয়

আপনার মাসিক কখন শুরু হয় এবং কখন শেষ হয় এই-সমস্ত সকল তথ্য জড়ো করে আপনাকে অনিয়মিত মাসিকের চিকিৎসা প্রদান করা হবে। 

এই রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে মাসিকের সময়ের পাশাপাশি চিকিৎসকেরা আপনি ক্র্যাম্পিং অনুভব করছেন কিনা, পিরিয়ডের মধ্যে রক্তপাত কেমন হচ্ছে বা ব্লিডিংয়ের সময় রক্তপিন্ড কেমন বের হচ্ছে এসমস্ত তথ্য জানতে চাইবেন। 

তথ্য জানার পাশাপাশি আপনার রোগের ধরণের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে চিকিৎসকেরা আপনাকে বেশকিছু টেস্ট দিতে পারে। বিশেষ করে: 

আল্ট্রাসাউন্ড: আল্ট্রাসাউন্ড জরায়ু ফাইব্রয়েড, পলিপ বা ডিম্বাশয়ের সিস্টের কারণে অনিয়মিত মাসিক বা পিরিয়ড টেস্ট করতে এই ধরণের টেস্ট দেওয়া হয়। 

এন্ডোমেট্রিয়াল: জরায়ুর আস্তরণ থেকে টিস্যুর অবস্থা সম্পর্কে জানতে এই ধরণের টেস্টের প্রয়োজন পড়ে। এটি মূলত রোগীর এন্ডোমেট্রিওসিস, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা বা প্রি-ক্যানসারাস কোষ নির্ণয় করতে সাহায্য করে।

হিস্ট্রোসকপি: অস্বাভাবিক রক্তপাতের নির্দিষ্ট কারণগুলি খুঁজে বের করতে জরায়ু রিলেটেড এই টেস্টের প্রয়োজন পড়ে। 

চিকিৎসা 

অনিয়মিত মাসিকের কারণ সম্পর্কে জানার পর আপনি বিভিন্ন ঔষধ কিংবা থেরাপির সাহায্যে এই সমস্যার সমাধান করতে পারেন৷ যাদের পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম (PCOS) এর মতো অবস্থায় পড়তে হচ্ছে তারা পিরিয়ডকে আরও নিয়মিত করতে উপযুক্ত গর্ভনিরোধক পিল সেবন করতে পারেন। 

পাশাপাশি থেরাপি হিসাবে নিতে পারেন হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি বা এইচআরটি সার্ভিস। সেই সাথে যদি আপনার মাঝে অনিয়মিত মাসিকের কারণ হিসাবে বাড়তি ওজন এবং মানসিক চাপের সমস্যা দেখা দেয় সেক্ষেত্রে ভালো কোনো সাইকলজিস্ট কিংবা জিম স্পেশালিষ্টের সাহায্য নিতে পারেন। 

তবে এই চিকিৎসার ক্ষেত্রে বা চিকিৎসা গ্রহণের পূর্বে টেস্ট করিয়ে নেবেন। শরীরের চাহিদা এবং রোগের পরিস্থিতি বোঝে ডাক্তার আপনাকে উপযুক্ত ট্রিটমেন্টটুকু সাজেস্ট করবে। 

ঘরোয়া কিছু উপায়  

অনিয়মিত মাসিকের কারণ জানার পর অতিরিক্ত পরিমাণে চিন্তিত হবেন না। এতে করে মানসিক চাপ বেড়ে যেতে পারে। এর পরিবর্তে শুরুতে ঘরোয়া কিছু টিপস ফলো করতে পারেন। পাশাপাশি কিছুটা পরিবর্তন আনতে পারেন অনিয়ন্ত্রিত লাইফস্টাইলে। চলুন অনিয়মিত মাসিকের সমস্যা দূর করার বেশকিছু ঘরোয়া টিপস সম্পর্কে জানি: 

১. হলুদ: পিরিয়ডের ডেটসহ সবকিছু ঠিক রাখতে এবং মানবদেহের হরমোনাল ব্যালেন্স সঠিকরূপে বজায় রাখতে হলুদের ব্যবহার করা যেতে পারে। ১ চা চামচ হলুদ নিয়মিতভাবে দুধ, মধু বা গুড়ের সাথে মিশিয়ে খেলে এর সর্বোচ্চ উপকারিতা পাওয়া যায়। 

২. ব্যায়াম: যাদের বাড়তি ওজন রয়েছে তাদের অনিয়মিত মাসিকের সমস্যা দেখা দেবে এবং এটি বেশ কমন বিষয়। সুতরাং বাড়তি ওজনের নারীদের উচিত ওজন কমাতে সঠিক ডায়েট চার্ট ফলো করা এবং নিয়মিতভাবে ব্যায়াম করে শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা। 

৩. দারুচিনি: ১ কাপ দুধের সাথে ১ টি দারুচিনি সিদ্ধ করে খেয়ে নিন। দেখবেন পিরিয়ড রিলেটেড সকল সমস্যা কিছুটা দূর হয়েছে। যাদের দুধে এলার্জি আছে তারা চাইলে কাঁচা দারুচিনি চিবিয়েও খেতে পারেন। 

৪. চাপমুক্ত: মানসিক চাপ হলো অনিয়মিত মাসিকের অন্যতম কারণ। সুতরাং বাড়তি টেনশনকে তোয়াক্কা না করে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করুন। অর্থ্যাৎ কোনো সমস্যায় টেনশন করবেন না, তবে ভিন্ন উপায় খুঁজে বের করবেন। এতে করে একইসাথে মানসিক চাপমুক্ত থাকার পাশাপাশি চিন্তাশীল ব্যাক্তিত্ব তৈরির পথও সুগম হবে। 

৫. আদা: আদা আমাদের ঘরে সবসময়ই থাকে। আপনি চাইলে এই আদার ব্যবহার করেও অনিয়মিত মাসিকের সমস্যা দূর করতে পারেন। ১ কাপ পানিতে ছোট ১ টুকরা আদা ৫ মিনিটের জন্য সিদ্ধ করে পানিটুকু পান করে নিলেই ধীরে ধীরে এর পজেটিভ রিয়েকশন আপনার শরীরে কাজ করা শুরু করবে। 

শেষ কথা

মনে রাখবেন অনিয়মিত মাসিকের কারণ হিসাবে অনেকগুলি পয়েন্ট আপনাকে মাথায় রাখতে হবে। যেমন অতিরিক্ত ভ্রমণ, মানসিক চাপ, বাড়তি ওজন, ক্যাফেইন জাতীয় খাবার-দাবারের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার কিংবা ধুমপান। 

আর এসব কারণকে আমলে না নিয়ে আপনি যদি সমাধান খুঁজেন, চিকিৎসা গ্রহণের জন্যে তাড়াহুড়ো করেন সেক্ষেত্রে তা হিতে বিপরীত হতে পারে। সুতরাং কারণ বুঝে নিজের বদ অভ্যাসগুলিকে দূর করার চেষ্টা করুন। এতে করে তুলনামূলকভাবে কম ঔষধ সেবনে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতে সক্ষম হবেন৷ 

অনিয়মিত মাসিক সম্পর্কিত প্রশ্ন উত্তর / FAQ

১. অনিয়মিত মাসিকের কারণ কি কি? 

উত্তরঃ অনিয়মিত মাসিকের কারণ হলো বিশেষ কিছু ঔষধের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার, ধুমপান, মানসিক চাপ, অতিরিক্ত ভ্রমণ এবং ক্যাফেইন জাতীয় খাবার গ্রহণ। 

২. অনিয়মিত মাসিকের ঔষধের নাম কি? 

উত্তরঃ অনিয়মিত মাসিকের ঔষধের নাম হলো সাইক্লোসিম সি এক্স ট্যাবলেট। তবে এই ট্যাবলেট চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া গ্রহণ করা যাবে না। 

৩. অনিয়মিত মাসিকের লক্ষণ কি কি? 

উত্তরঃ অনিয়মিত মাসিকের লক্ষণ হলো ৩৫ দিনের মধ্যে নতুনভাবে মাসিক শুরু না হওয়া, ২৮ দিনের ভেতর ২ বার মাসিক শুরু হওয়া, স্তনে ব্যাথা করা, মেজাজে পরিবর্তন আসা। 

৪. মাসে ২-৩ বার মাসিক হওয়ার কারণ কি? 

উত্তরঃ মাসে ২ ৩ বার মাসিক হওয়ার কারণ হলো নারী দেহে থাইরয়েডের সমস্যা থাকা। 

৫. ঘন ঘন মাসিক হলে কি করণীয় কি? 

উত্তরঃ ঘন ঘন মাসিক হলে কি করণীয় হলো লাইফস্টাইলে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা এবং দ্রুত গাইনি চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া। 

আরও পড়ুন-

ঘন ঘন মাসিক হলে কি করণীয় ও নিয়ন্ত্রণের থেরাপি

অতিরিক্ত ঘাম কমানোর ঔষধ, এর প্রতিকার ও চিকিৎসা

Leave a Comment