ফরজ গোসলের নিয়ম ও গোসলের ইসলামিক নিয়মকানুন

ফরজ গোসলের নিয়ম 

ফরজ গোসল (Obligatory Bath) সম্পর্কে কম বেশি সকলেই অবগত আমরা। বিভিন্ন কারনে পবিত্রতা অর্জন করার জন্য ফরজ গোসল করতে হয়। তবে সঠিকভাবে ফরজ গোছলের নিয়ম সম্পর্কে অনেকেই জানি না। সঠিকভাবে ফরজ গোসল না করলে তিনি অপবিত্রই রয়ে যাবেন।

তাই সঠিক নিয়ম জানা খুবই জরুরী। নিয়ম জানার আগে জেনে নিন গোসল এর অর্থ কি। আরবি শব্দ গোসলের অর্থ হচ্ছে পুরো শরীর ধোয়া। শরিয়তের পরিভাষায় গোসল অর্থ হলো, পবিত্রতা এবং আল্লাহর নৈকট্য পাবার জন্য পবিত্র পানি দিয়ে পুরো শরীর ধোয়া।

আল্লাহ পাক নির্দেশ দিয়েছেন, “আর যদি তোমরা অপবিত্র হও, তবে সারা দেহ পবিত্র করে নাও।” (সূরা মায়েদা, আয়াত – ৬)।  আজকে আলোচনা করা হবে ফরজ গোসলের নিয়ম সম্পর্কে। এছাড়াও কখন গোসল ফরজ হয়, গোসলের ফরজ কয়টি, গোসলের শিষ্টাচার ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনা করা হবে। সম্পূর্ণ আর্টিকেল পড়ার অনুরোধ রইলো। 

আরও পড়ুনঃ নতুন বছরের ইসলামিক স্ট্যাটাস সম্পর্কিত তথ্য

ফরজ গোসলের গুরুত্ব 

ফরজ গোসলের নিয়ম

কুরআনের বিভিন্ন স্থানে আল্লাহ তায়ালা মানুষদেরকে বিভিন্ন ধরনের (ক্ষেত্র বিশেষে) আদেশ দিয়েছেন। তারমধ্যে একটি আদেশ হলো, “তোমরা সবসময়ই পবিত্র অবস্থায় থাকবে। কোনো কারণে যদি অপবিত্র হয়ে যাও, তাহলে তৎক্ষনাৎ পবিত্র হয়ে নিবে তোমরা।”

ফরজ গোসলের মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জন করতে পারবেন। ফরজ গোসলের নিয়ম সম্পর্কে আলোচনা করার আগে এর গুরুত্ব সম্পর্কে জেনে নিন। ফরজ গোসল না করে নামাজ, কুরআন তেলাওয়াত ও স্পর্শ করা, তাওয়াফ এবং মসজিদে গমন করা নিষেধ।

আবার কোনো কারণ ছাড়া এই অবস্থায় এক ওয়াক্ত নামাজের সময় অতিবাহিত হওয়া মারাত্মক গুনাহ। লজ্জা অথবা গোসল করার পরিবেশ নেই মনে করে সময়ক্ষেপণ করা শরিয়তসম্মত ওজর নয়। তাই যতো দ্রুত সম্ভব ফরজ গোসল করতে হবে।

অপবিত্র অবস্থায় মনে মনে জিকির-আজকার করা, অজিফা পাঠ করা, দোয়া-দরুদ পড়া, ঘরের কাজ করা, পানাহার করা ইত্যাদি কাজে কোনো বাধা নিষেধ নেই। (বাদায়েউস সানায়ে ১/১৫১)

আবু হুরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত আছে ; তিনি বলেন, মদীনার কোনো এক পথে রাসুল (সা:) এর সঙ্গে আমার দেখা হয়ে গেলো। তখন আমি (জুনুবি অর্থাৎ ফরজ) গোসলের অবস্থায় ছিলাম। নিজেকে নাপাক মনে করে তখন সরে পড়লাম।

গোসল করার পর পুনরায় রাসুল (সা:) এর সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, আবু হুরায়রা! কোথায় গিয়েছিলে? আমি বললাম, আমি অপবিত্র অবস্থায় আপনার সাথে বসা সমীচীন মনে করিনি।

রাসুল (সা:) বললেন, সুবহানাল্লাহ! মুমিন নাপাক থাকতে পারে না। (বুখারী : ২৭৯)। এর অর্থ হচ্ছে, গোসল ফরজ হওয়ার মতো কিছু হলে তার জন্য কিছু নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবে ব্যক্তিবিশেষ সে নাপাক না। 

গোসল ফরজ হওয়ার কারণ 

সুস্বাস্থ্য এবং সুস্থতার জন্য প্রতিদিনই গোসল করা খুবই ভালো অভ্যাস। তাছাড়া হজ-ওমরার সময় এবং জুম্মার দিন গোসল করা আবশ্যক। তবে কয়েকটি কারণে গোসল করা ফরজ হয়ে যায়। তখন একে ফরজ গোসল বলে। যেসব কারণে গোসল ফরজ হয় তা নিচে দেওয়া হলো।

  • নারী এবং পুরুষের মিলনের পর। মনে রাখবেন সহবাসের পর বীর্যপাত হোক বা না হোক, ফরজ গোসল করতেই হবে।
  • স্বপ্নদোষ অথবা উত্তেজনাবশত বীর্যপাত ঘটলে।
  • মেয়েদের হায়েয-নিফাস শেষ হওয়ার পর। 
  • নব-মুসলিম অর্থাৎ ইসলাম গ্রহণ করার পর। 
  • জীবিতদের ওপর মৃত ব্যক্তিকে গোসল করানো ফরজ। 

ফরজ গোসলের ফরজ সমূহ 

ফরজ গোসলের নিয়ম নিচে আলোচনা করা হবে। তবে তার আগে জেনে নিন ফরজ গোসলের কয়টি ফরজ আছে এবং ফরজ সমূহ কি কি। মোট তিনটি গোসলের ফরজ। এই তিনটির কোন একটি বাদ পড়ে গেলে গেলে ফরজ গোসল (Obligatory Bath) আদায় করা হবে না। ফরজ গোসলের ফরজ সমূহ হচ্ছে –

১. গড়গড়ার সাথে কুলি করা। তবে রোজা রাখা অবস্থায় সাধারণভাবে কুলি করতে হবে। (বুখারী, ইবনে মাজাহ) 

২. নাকে পানি দেওয়া। অর্থাৎ নাকের নরম অংশ আঙ্গুল দ্বারা ভিজানো।  (বুখারী, ইবনে মাজাহ) 

৩. অতঃপর সারা দেহে পানি ঢালা এবং ভালোভাবে গোসল করা। নাভির ভেতর আঙ্গুল দিয়ে ভেজাবেন। নারীদের গুপ্তাঙ্গ সুন্দর ভাবে ধৌত করবেন। মনে রাখবেন শরীরের কোন অংশ যেন এক ফোঁটাও শুকনা না থাকে। (আবু দাউদ) 

ফরজ গোসলের সঠিক নিয়ম 

ধারাবাহিকভাবে সাতটি নিয়মে ফরজ গোসল সম্পন্ন করা উত্তম। ফরজ গোসলের নিয়ম নিচে দেওয়া হল। 

১. গোসল করার শুরুতে “বিসমিল্লাহ” বলা। তবে গোসলখানা এবং টয়লেট একসঙ্গে থাকলে “বিসমিল্লাহ” মুখে উচ্চারণ করে বলা যাবে না। 

২. দুই হাত ধোয়া। অর্থাৎ দুই হাতের কব্জি পর্যন্ত ধোয়া। 

৩. লজ্জাস্থান ধোয়া। লজ্জাস্থান বাম হাতের পানি দ্বারা পরিষ্কার করা। যদি সম্ভব হয় ইস্তিঞ্জা অর্থাৎ প্রস্রাব করে নেওয়া। এতে নাপাকি সম্পূর্ণরূপে বের হয়ে যাবে। 

৪. নাপাকি পরিষ্কার করা। কাপড়ে বা শরীরের কোন অংশে নাপাকি লেগে থাকলে তা পরিষ্কার করতে হবে। 

৫. ওযু করা। পা ধোয়া ব্যতীত নামাজের ওযুর মতোই ওযু করতে হবে। 

৬. এরপর গোসলের তিনটি ফরজ কাজ করতে হবে। 

  • কুলি করা। 
  • নাকে পানি দেওয়া এবং  
  • সমস্ত শরীর ভালো ভাবে ধুয়ে নেওয়া। শরীরের কোন অংশ যেন শুকনো না থাকে। 

৭. পরিশেষে গোসলের স্থান থেকে একটু সরে এসে দুই পা ভালোভাবে ধোয়া। 

রাসূল (সা:) যেভাবে গোসল করতেন 

হাদিসে বর্ণিত আছে ; মায়মুনা (রা:) বলেন, আমি আল্লাহর রাসূল (সা:) এর জন্য গোসলের পানি রাখলাম। তা দিয়ে তিনি জানাবাতের (অপবিত্রতা হতে পবিত্র হওয়ার) গোসল করেন। আল্লাহর নবী (সা:) পাত্র হাতে নিয়ে নিজের ডান হাতের ওপর কাত করে দুই বা তিনবার ধৌত করেন। 

অতঃপর তিনি তার লজ্জাস্থানের উপর পানি ঢেলে বাম হাত দিয়ে ধৌত করেন। পরে তিনি মাটির উপর হাত ঘষে (দুর্গন্ধ মুক্ত হওয়ার জন্য) তা পানি দিয়ে ধৌত করেন। 

অতঃপর তিনি কুলি করেন এবং নাক পরিস্কার করেন। অতঃপর মুখমণ্ডল এবং দুই হাত ধৌত করেন। এরপর তিনি নিজের মাথা এবং সর্বাঙ্গে পানি ঢালেন। পরে সেই স্থান থেকে তিনি অল্প দূরে সরে গিয়ে উভয় পা ধৌত করেন। (আবু দাউদ, হাদিস : ২৪৫)

গোসলের শিষ্টাচার 

ফরজ গোসলের নিয়ম সম্পর্কে তো জানলেন। এবার গোসল করার শিষ্টাচার সমূহ নিচে আলোচনা করা হলো –

  • উঁচুস্থানে বসে গোসল করতে হবে। যাতে পানি গড়িয়ে যায় এবং পায়ে ছিটা না লাগে। পানির অপচয় করা যাবে না। বসে বসে গোসল করবেন। 
  • লোকসমাগমের স্থানে গোসল করবেন না। পবিত্র জায়গায় গোসল করতে হবে। ডান দিক থেকে গোসল শুরু করতে হবে। (বাদায়েউস সানায়ে ১/৩৪, রদ্দুল মুহতার ১/৯৪)
  • বাহ্যিক অঙ্গের চুল পরিমান জায়গাও যদি শুকনো থাকে তাহলে ফরজ গোসল শুদ্ধ হবে না। (শরহে মুখতাসারুত তাহাভি ১/৫১০) 
  • নেইলপলিশ ,সুপার গ্লু বা রঙ ইত্যাদি যা শরীরে পানি পৌঁছাতে প্রতিবন্ধকতার কাজ করে, তা উঠিয়ে গোসল করতে হবে। কারণ শরীরের প্রতিটি অংশে পানি পৌঁছানো জরুরী। নতুবা ফরজ গোসল শুদ্ধ হবে না। 
  • ফরজ গোসলের নিয়ম এর ক্ষেত্রে পুরুষের দাড়ি এবং মাথার চুল গোড়াসহ সম্পূর্ণ ভালোভাবে ভিজাতে হবে। নারীদের চুল বাঁধা থাকলে সেক্ষেত্রে খোলা ছাড়া যদি চুলের গোড়ায় পানি পৌঁছানো সম্ভব হয়, তবে না খুলে গোড়ায় পানি পৌঁছানোই যথেষ্ট। আর চুল যদি খোলা থাকে তাহলে পুরুষের মতো সম্পূর্ণ চুল ধৌত করা ফরজ। (বাদায়েউস সানায়ে ১/৩৪, রদ্দুল মুহতার ১/১৪২)
  • ফরজ গোসলের ক্ষেত্রে নারীদের কানের দুল এবং নাক ফুল নাড়িয়ে ছিদ্রে পানি পৌঁছানো জরুরী। (আল মুহীতুল বুরহানি ১/৮০)
  • কানের ভিতর এবং নাভিতে পানি পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বিশেষ সর্তকতা জরুরি। 
  • অনেকের বিভিন্ন রোগের কারণে দাঁতে এমন ভাবে ক্যাপ লাগানো হয়, যার ফলে কুলি করতে নিচে পানি পৌঁছায় না। ক্যাপ খুললেও তখন ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। এক্ষেত্রে গোসলের সময় তা খোলা জরুরী নয়। তবে সহজে খোলা যায় যদি এমন কিছু দাঁতে লাগানো থাকে, তাহলে তা খুলে তার নিচে পানি পৌঁছানো জরুরী। (রদ্দুল মুহতার ১/১৫৪, আহসানুল ফতোয়া ২/৩২)

শেষ কথা 

আশা করছি উপরের আলোচনা থেকে ফরজ গোসলের নিয়ম সম্পর্কে একটি ধারণা পেয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে সঠিকভাবে কুরআন এবং সহীহ সুন্নাহ মেনে চলার তৌফিক দান করুন। পূর্বে না জেনে করা ভুলের ক্ষমা করুন। আমিন।

ফরজ গোসলের নিয়ম সম্পর্কে যদি আরও কোন প্রশ্ন থাকে অবশ্যই কমেন্ট বক্সে জানাতে ভুলবেন না। আমরা সর্বদা চেষ্টা করব আপনার মূল্যবান প্রশ্নের উত্তর দিতে। আর্টিকেলটি ভালো লাগলে শেয়ার করে অন্যদেরকে জানানোর সুযোগ করে দিন। ধন্যবাদ। 

ফরজ গোসলের নিয়ম সম্পর্কিত প্রশ্ন এবং উত্তর / FAQ’s

১. গোসলের দোয়া কি? 

উত্তর : গোসলের দোয়া নিচে দেওয়া হল – “নাওয়াইতুয়ান গোছলা লিরাফিল জানাবা-তি।”

২. ফরজ গোসলের নিয়ত কি? 

উত্তর : ফরজ গোসলের নিয়ত নিচে দেওয়া হল – “নাওয়াইতুল গুছলা লিরাফইল জানাবাতি।”  এর অর্থ হচ্ছে, আমি নাপাকি থেকে পাক হওয়ার জন্য গোসল করছি। 

৩. গোসল করার পর কি ওযু করতে হয়? 

উত্তর : গোসল করার শুরুতে ওযু করা সুন্নত। যেহেতু গোসলের মাধ্যমে ওযু হয়ে যায়, তাই গোসল করার পর অজু ভঙ্গের কারণ পাওয়া না গেলে পুনরায় ওযু করার দরকার নেই। 

৪. গোসল না করে নামাজ পড়া যাবে কি? 

উত্তর : গোসল যদি ফরজ হয় অবশ্যই নামাজের আগে গোসল করতে হবে। কোন কারণে যদি গোসল করার সময় না পান সেক্ষেত্রে অজু করে যে কোন কাজ করতে পারবেন। তবে সময় পেলে গোসল করে নেওয়াই উত্তম। আর যদি গোসল ফরজ না হয় সেক্ষেত্রে অজু করে নামাজ পড়তে পারবেন। 

আরও পড়ুন-

দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তির দোয়া, ইবাদত ও জীবনধারণ

তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম ও ফযিলত

Leave a Comment