লিচুর উপকারিতা ও লিচু খাওয়ার পূর্বসতর্কতা

লিচুর উপকারিতা

ষড় ঋতুর এই দেশে বিভিন্ন মওসুমে বাহারি ফলের সমাহার দেখা যায়। গ্রীষ্মকাল ষড়ঋতুর মধ্যে অন্যতম একটি ঋতু। গ্রীষ্মকালিন সময়ে ফলগুলোর মধ্যে জনপ্রিয় একটি ফল হল লিচু। আকারে ছোট হলেও স্বাদে অনেক মিষ্টি। 

রসালো এই ফলটি সকলের কাছেই অতি পছন্দের। রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুর, যশোর, চট্টগ্রাম, ঢাকা, সিলেট, মৌলভীবাজার, পাবনা, কুষ্টিয়া লিচু চাষের জন্য বিখ্যাত। তবে স্বাদের বিচারে নয় লিচুর উপকারিতা রয়েছে অনেক। ছোট এই ফলের রয়েছে নানাবিধ পুষ্টিগুণ। 

আমরা শুধু লিচু খাওয়ার ব্যাপারে চিন্তা করি। কিন্তু এর উপকারিতা সম্পর্কে তেমন কিছু জানি না। আজকের আর্টিকেলে লিচুর উপকারিতা সম্পর্কে নানা তথ্য তুলে ধরব। আশা করছি আপনারা জেনে উপকৃত হবেন।

লিচুর পুষ্টিমান 

পুষ্টি বিজ্ঞানিদের মতে প্রতি ১০০ গ্রাম লিচুতে খাদ্য উপাদান থাকে-  শর্করা ১৭ গ্রাম, জলীয় অংশ ৮১.৭৫ গ্রাম, প্রোটিন ১.১ গ্রাম, চর্বি ০.৪৪ গ্রাম, কার্বোহাইড্রেট ১৬.৫৩ গ্রাম, আঁশ ১.৩১ গ্রাম, চিনি ১৫.২৩ গ্রাম, লোহা ০.৩১ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি-১০.০২ মিলিগ্রাম,

ভিটামিন সি ৭২ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি-২ ০.০৭ মিলিগ্রাম, নিয়াসিন ০.৬ মিলিগ্রাম, ভিটামিন কে ০.৪২ মিলিগ্রাম ও ভিটামিন ই ০.০৭ মিলিগ্রাম। এছাড়াও  ম্যাগনেসিয়াম ১০ গ্রাম, পটাশিয়াম রয়েছে ১৭০ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম রয়েছে  ১০ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ৩১.১ মিলিগ্রাম। 

লিচুর উপকারিতা

এছাড়াও লিচুতে আরও কিছু প্রয়োজনীয় উপাদান আছে – 

১। ডায়াটারি ফাইবার – যা শরীরের ওজন কমাতে সাহায্য করে

২। অলিগেনল – এটি শরীরে অ্যান্টি অক্সিডেণ্ট ও অ্যান্টি ইনফ্লুয়েঞ্জা হিসাবে কাজ করে। রক্ত লালচে ও স্বাভাবিক রাখে,  

৩। পেকটিন – অন্ত্রের মল পরিষ্কার করে বের করতে সাহায্য করে।

৪। পলিফেনল – চর্বি কোষকে ভাঙতে সাহায্য করে ও যকৃতে চর্বি জমতে বাধা দেয়।

৫। ফ্ল্যাভনয়িডস – যা স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে। 

লিচুর যত উপকারিতা 

১। হজমের জন্য ভাল

লিচু হজমের জন্য ভাল। কারন লিচুতে ফাইবার ও পানি থাকে যা পেটের সমস্যা থেকে মুক্তি দিয়ে পেটকে আরামে রাখে।

২। হাড় ভাল রাখে

লিচুতে রয়েছে ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস, আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ এবং কপার যা হাড়ের ক্যালসিয়াম শোষণে সাহায্য করে। বিশেষজ্ঞদের মতে দৈনিক লিচু খেলে হাড়ের ভঙ্গুরতা হ্রাস পায়। এর সাথে অস্টিওপোরোসিস ও ফ্র্যাকচারের মত সমস্যাও কমে যায়। তাই হাড় ভাল রাখতে দৈনিক লিচু খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে। 

৩। কিডনির জন্য উপকারী 

লিচুতে পটাশিয়াম ও পানি রয়েছে যা কিডনিতে থাকা দূষিত পদার্থ বের করে দেয়। এছাড়াও লিচু ইউরিক এসিডের ঘনত্বও কমায়। ফলে কিডনি জনিত রোগ হবার সম্ভাবনা কমে যায়। 

৪। ভিটামিন বি 

লিচুতে আছে  ভিটামিন সি, কে, ই এবং বি৬, রাইবোফ্লাভিন এবং নিয়াসিন জাতীয় প্রয়োজনীয় উপাদান। প্রতিদিন লিচু খেলে ভিটামিন বি৬ এর ১০% পর্যন্ত পূরণ করা যায়। এই ভিটামিন লোহিত রক্ত কনিকা তৈরিতে ও প্রদাহ জনিত রোগের ঝুকি হ্রাস করে।

৫। লিচুর উপকারিতাব্যাথা দূর করে 

অবাক লাগলেও সত্যি যে লিচু লিচু একটি কার্যকরী ব্যাথানাশক ফল। লিচু শরীরের টিস্যু ক্ষয় প্রতিরোধ করে। 

৬। ওজন কমাতে সাহায্য করে

লিচু আঁশ যুক্ত হওয়ায় লিচু খেলে তা দীর্ঘ সময় পেট ভরিয়ে রাখে। যারা ওজন নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকেন তারা নিয়মিত লিচু খেতে পারেন। লিচুর উপকারিতার মধ্যে একটি হল লিচুতে ক্যালরি কম থাকায় ওজন বৃদ্ধির ভয় থাকে না। লিচুতে থাকা ফিনলিক যৌগ ওজন নিয়ন্ত্রন ও লিভারের সুরক্ষা বৃদ্ধি করে। 

৭। হার্ট ভাল রাখতে সাহায্য করে

হৃদপিণ্ডের স্বাস্থ্য ভাল রাখতে লিচু অনেক সহায়ক। লিচুতে থাকা অলিগনল, নাইট্রিক অক্সাইড তৈরিতে সাহায্য করে। এই উপাদান হৃদপিণ্ডে রক্ত চলাচলের গতিকে ত্বরান্বিত করে। লিচুতে থাকা ফ্ল্যাভোনয়েড ভাস কুলার ফাংশন কে ভাল রাখে। ফলে হৃদরোগের ঝুকি অনেকটা কমে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত লিচু খেলে হৃদরোগের ঝুকি ৫০ শতাংশ কমে যায়। 

৮। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় 

লিচুতে থাকা অলিগোনল ভাইরাসকে বিস্তার লাভ করতে বাধা দেয়। ফলে শরীরে রোগের সংক্রমন কমে যায়। আর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এতে থাকা লিচিট্যানিন এ২ শরীরে ভাইরাস ছড়াতে দেয় না। লিচুর উপকারিতা মোতাবেক পরিমিত লিচু খাওয়া উচিত।

৯। কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রন করে

লিচু রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রনেও সাহায্য করে। নিয়মিত লিচু খেলে কোলেস্টেরল বৃদ্ধির ভয় থাকে না। ফলে ডায়াবেটিসের রোগীরাও লিচু খেতে পারে। 

১০। ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে

লিচু চুল ও ত্বকের যত্নে কার্যকরী ভুমিকা পালন করে। নিয়মিত লিচু খেলে তা ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে ও নতুন চুল গজাতে সাহায্য করে। ত্বকের বলিরেখা দূর করে ও বয়সের ছাপ পড়তে দেয় না। যাদের মুখে ব্রনের সমস্যা আছে, মুখে কাল দাগ পড়ে তাদের জন্য লিচু অনেক উপকারী। 

১১। বয়স্ক মহিলাদের জন্য লিচু অনেক উপকারী 

১২।মহিলাদের স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে লিচু।

১৩। হাঁপানি বা আজমা রোগীদের জন্য লিচু অনেক উপকারী।

লিচু খাওয়ার পূর্বে সতর্কতা 

১। অধিক পরিমানে লিচু খেলে হাইপোগ্লাইসেমিয়ার দরুন রক্তে গ্লুকোজ কমে যেতে পারে। যারা ডায়াবেটিসের রোগী তাদের সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত।

২। অতিরিক্ত পরিমানে লিচু খেলে রক্ত চাপ হঠাৎ কমে যেতে পারে। ফলে অসুস্থ হবার ঝুকি বেড়ে যেতে পারে। 

৩। লিচু গরম ফল বিধায় অতিরিক্ত খেলে তা শরীরের তাপমাত্রা নষ্ট করতে পারে, গলা ব্যাথা, মুখের ভিতরে ঘা বা নাক দিয়ে রক্ত যেতে পারে। 

৪। বেশি লিচু খেলে রিউমাটয়েড আরথ্রাইটিস, মাল্টিপল স্ক্লেরসিস, লুপাস জাতীয় রোগ বৃদ্ধির আশংকা থাকে।

৫। যাদের সার্জারির প্রয়োজন রয়েছে তাদের সার্জারির ২সপ্তাহ পূর্বে লিচু খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। 

৬। প্রয়োজনের তুলনায় বেশি লিচু খেলে ওজন বৃদ্ধি পেতে পারে।

৭। খালি পেটে লিচু খেলে বিষক্রিয়া হতে পারে। 

পরিশেষে 

লিচু একটি মওসুমি ফল হলেও তা অনেক দিক দিয়ে উপকারী। কারন লিচুর রয়েছে বিভিন্ন পুষ্টিগুণ। বিভিন্ন অসুখে লিচু খাওয়ার ফলে শরীর ভাল থাকে। নিয়মিত লিচু খাওয়ার উপকারিতা হল তা শরীরকে নানা ভাবে সুরক্ষিত রাখে।

তবে মাত্রাতিরিক্ত কোন কিছু খাওয়ার ফলে তা ক্ষতি ও করতে পারে। তাই পরিমিত পরিমানে লিচু খেলে লিচুর উপকারিতা বেশি পাওয়া যাবে। সেই বিষয়ে আমাদের নজর দেয়া উচিত। 

লিচু সম্পর্কিত প্রশ্ন ও উত্তর / FAQ 

১। লিচু খেলে কি ক্ষতি হয়?

উত্তরঃ অনেকক্ষেত্রে খালি পেটে লিচু খেলে শরীরে বিষক্রিয়া হতে পারে। এই ফল রক্তচাপ কমাতে পারে। তবে বিপজ্জনকভাবে রক্তচাপ কমলে ঝাপসা দৃষ্টি, মাথা ঘোরা, ঠান্ডা, বমি বমি ভাব, অগভীর শ্বাসপ্রশ্বাস এবং চরম ক্লান্তি দেখা দেয়ার মতো সমস্যা দেখা দেয়।

২। লিচু খেলে কি সুগার বাড়ে?

উত্তরঃ আপনি যদি নিয়ন্ত্রণ না করে লিচু খান, তাহলে আপনার রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকবে। 

৩। লিচু খাওয়ার পর পানি খাওয়া যাবে কি?

উত্তরঃ ফল খাওয়ার পরে জল এড়ানো উচিত কারণ এই সংমিশ্রণটি পেটে শোষণ এবং হজম প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করতে পারে, ফলে অ্যাসিডিটি হয়। এই কারণে কিছু লোক ফল খাওয়ার পরে অস্বস্তি বোধ করে। ফল খাওয়ার অন্তত এক ঘণ্টা পর পানি পান করার পরামর্শ দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন-

জাফরান এর উপকারিতা, স্বাস্থ্যগুন ও ব্যবহারবিধি

Leave a Comment