আমের উপকারিতা, আমের গুনাগুণ ও এর ব্যাবহার

আমের উপকারিতা

গ্রীষ্মের  প্রচণ্ড তাপদাহে বাঙ্গালীর মুখে হাসি ফুটাতে পারে একটি মাত্র ফল। আর সেই ফলের নাম হচ্ছে আম। আমকে বলা হয় ফলের রাজা যা সকল ফলের মধ্যে গুণাবলি ও স্বাদে অতুলনীয়। এমন কোন মানুষ খুজে পাওয়া যাবেনা যে আম পছন্দ করে না। ছোট বড় সব বয়সের মানুষ আম খেতে পছন্দ করে। 

তবে স্বাদের দিক দিয়ে নয় আমের উপকারিতার সাথে রয়েছে অনেক পুষ্টিগুণ। আর তাই কাঁচা কিংবা পাকা উভয়ই আম ব্যাবহৃত হয় বাঙ্গালীর রসনাতৃপ্তিতে। গরমে পাকা আমের শরবত যেমন প্রচলিত তেমনি মরিচ আর লবন দিয়ে কাঁচা আমের ভর্তাও অনেকের কাছে লোভনীয়।

পাকা আমে রয়েছে প্রচুর ভিটামিন, মিনারেল, খনিজ ও ক্যারোটিন যা চোখের জন্য অনেক উপকারী। এছাড়াও আম শরীরে প্রয়োজনীয় শক্তি জোগাতে ও হাড়ের সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে। 

আজকের আর্টিকেলে আমের উপকারিতা ও গুনাগুণ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব। আশা করছি আপনারা উপকৃত হবেন। 

আজকের আলোচ্য বিষয়

আম কেন খাব 

আম হচ্ছে ফলের রাজা। শুধু তাই নয়, আমের রয়েছে রাজার মতই অনেক পুষ্টিগুণ। অনেকের মনে প্রশ্ন থাকে আম খেলে কি কোন উপকার হবে বা কোন পুষ্টি কি পাব? সেই প্রশ্নের উত্তর অবশ্যই আছে। পুষ্টিবিদদের মতে শরীরের জন্য কাঁচা বা পাকা উভয় আমের উপকারিতা রয়েছে। পরিমিত পরিমানে আম খেলে তা শরীরের কোন ক্ষতি করে না। 

আমের উপকারিতা

আমে রয়েছে প্রি বায়োটিক, ডায়েটারি ফাইবার, ভিটামিন, খনিজ, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। এই অ্যান্টি- অক্সিডেন্ট কোলন ক্যান্সার ও স্তন ক্যান্সারের ঝুকি কমাতে সাহায্য করে। এছাড়াও লিউকমিয়া ও প্রোস্টেট ক্যান্সার প্রতিরোধী অনেক উপাদান রয়েছে আমে। তাই পুষ্টিবিদরা পরিমিত পরিমান আম খেতে পরামর্শ দিয়ে থাকে। 

আমের পুষ্টির পরিমান 

পাকা আম এ প্রোটিনের পরিমান তুলনামুলক বেশি থাকে। প্রতি ১০০ গ্রাম আমে রয়েছে – ৭৪০ গ্রাম মাইক্রো গ্রাম ক্যারোটিন, ১.৩ গ্রাম আয়রন, ১৪ মিলিগ্রাম কালসিয়াম, ১৬ মিলি গ্রাম ফসফরাস, ১৬ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি, ০.৯ মিলিগ্রাম রিভফ্লেমিন ও ০.০৮ মিলিগ্রাম থায়ামিন, ০.৫ গ্রাম খনিজ লবন, অল্প পরিমান ভিটামিন এ, ভিটামিন বি৬ রয়েছে। এছাড়াও অ্যামাইনো এসিড, পটাশিয়াম ও কপার রয়েছে। 

প্রতি ১০০ গ্রাম পাকা আমে ১ গ্রাম প্রোটিন, ০.৭ গ্রাম ফ্যাট, ২০ গ্রাম শ্বেতসার রয়েছে। স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী বিটা ক্যারোটিন, আলফা ক্যারোটিন, ক্যাফিক এসিড রয়েছে পাকা আমে। 

আমের উপকারী দিক 

আমের স্বাদের প্রতি অনেকের দুর্বলতা রয়েছে। বিভিন্ন জাতের আমের স্বাদেও রয়েছে ভিন্নতা। তবে এর পুষ্টিগুন সকলের মধ্যে সমান। তবে শুধু স্বাদ বিচার করেই নয়, পুষ্টিবিদদের মতে আমের উপকারিতা অনেক বেশি। সেই সম্পর্কে আজ বিস্তারিত তুলে ধরা হল- 

১। ক্যান্সার প্রতিরোধে

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, আমের মধ্যে থাকা অ্যান্টি- অক্সিডেন্ট যেমন- কোয়েরসেটিন, ফাইসেটিন, আইসোকোয়েরসেটিন, অ্যাস্ট্রাগ্যালিন, গ্যালিক অ্যাসিড ও মিথাইল গ্যালেট রয়েছে যা কোলন ক্যান্সার, স্তন ক্যান্সার, প্রোস্টেট ক্যান্সার ও লিউকমিয়া প্রতিরোধে সহায়ক।

২। কোলেস্টেরল কমাতে

আমে থাকা উচ্চ মাত্রার ভিটামিন সি, পেকটিন ও ফাইবার রক্তে থাকা খারাপ কোলেস্টেরল তথা লো-ডেনসিটি লিপো প্রোটিন কমাতে সাহায্য করে। 

৩। ওজন কমাতে 

আমে থাকা বায়োএক্টিভ ও ফাইটোকেমিক্যাল উপাদান শরীরের ফ্যাট সেল ও ফ্যাট রিলেটেড জীনের বৃদ্ধি ঘটাতে সাহায্য করে। এটি ওজন বৃদ্ধিতে বাধা প্রদান করে। তবে পাকা আমের চেয়ে কাঁচা আমে চিনির পরিমান কম থাকে। তাই যারা ওজন কমাতে চান তাদের জন্য কাঁচা আম অনেক ভাল। 

৪। দৃষ্টি শক্তি বাড়াতে 

আমে রয়েছে বিটা ক্যারোটিন, আলফা ক্যারোটিন ও ভিটামিন এ। দৈনিক চাহিদার ৮% ভিটামিন মাত্র ৩/৪ কাপ আম কুচি খাওয়ার মাধ্যমে পূরণ করা যায়। এই উপাদান গুলো শরীরের অ্যান্টি- অক্সিডেন্ট এর পাশাপাশি চোখের জন্য অনেক উপকারী। 

৫। অ্যালকালী পদার্থ সংরক্ষণে 

আমের মধ্যে থাকা টারটারিক এসিড, মেলিক এসিড ও সাইট্রিক এসিড শরীরের অ্যালকালী পদার্থ সংরক্ষণে সাহায্য করে।

৬। ভিটামিন ই 

আমে বেশি পরিমানে ভিটামিন ই রয়েছে যা শরীরের জন্য অনেক উপকারী। 

৭। হজমে সহায়তা

আমে অনেক বেশি পরিমানে এনজাইম রয়েছে যা প্রোটিন ভাঙ্গার জন্য দায়ী। আমের উপকারিতাগুলোর মধ্যে একটি হল আমের এই আঁশ গুলো হজমে ও পরিপাকে অনেক সাহায্য করে। 

৮। হিট স্ট্রোক এর ঝুকি কমাতে

অধিক গরমে এক গ্লাস কাঁচা আমের শরবত হিট স্ট্রোকের ঝুকি অনেকটাই কমিয়ে দিতে পারে। আয়ুর্বেদিক এক গবেষণা থেকে জানা যায়, রোদের অধিক তাপ দেহের কর্মক্ষমতা হ্রাস করে দেয়, ফলে মাংস পেশি দুর্বল হয়ে যায়। এথেকে শরীর অচল হয়ে যায়। এই সময়ে কাঁচা আম, পানি ও চিনি বা গুরের তৈরি শরবত পান করলে হিট স্ট্রোকের মত সমস্যা থেকে বাচা যায়।

৯। ইমিউন সিস্টেম

ভিটামিন এ, ভিটামিন সি এর সাথে আরও ২৫ টিরও বেশি ক্যারোটিনয়েডস রয়েছে আমে যা আমাদের শরীরের ইমিউন সিস্টেম ভাল রাখতে সাহায্য করে। 

১০। ত্বক ও চুলের যত্নে

আমে উচ্চ মাত্রার ভিটামিন সি রয়েছে যা ত্বকের স্বাস্থ্যর জন্য জরুরী। এই ভিটামিন ত্বকের কোলাজেন তৈরিতে সাহায্য করে যা ত্বকে বয়সের ছাপ পড়তে দেয় না। আমে থাকা অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট চুলের ফলিকলকে অক্সিডেটিভ ড্যামেজ রোধ করতে সাহায্য করে। ফলে চুল পরার হার অনেক কমে যায়। 

১১। মিনারেলের ঘাটতি দূর করে

শরীরে মিনারেলের ঘাটতি দেখা দিলে বিভিন্ন ধরনের অসুখ দেখা দিতে পারে। আমে থাকা পটাশিয়াম শরীরের প্রয়োজনীয় লবনের ঘাটতি পূরণ করতে পারে। 

১২। স্মৃতি শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে

শিশুদের স্মৃতি শক্তি বৃদ্ধিতে আম অনেক দরকারি। আমে আছে গ্লুটামিক, ফলিক এসিড, যা মস্তিস্কের কোষগুলোকে ত্বরান্বিত করে। এতে মনোযোগ বৃদ্ধি পায়। ফলে মস্তিস্কের উপর চাপ কমাতে আমের উপকারিতা অনেক বেশি। 

১৩। ঠাণ্ডাজনিত সমস্যা দূর করতে

আম খাওয়ার উপকারিতা মধ্যে অন্যতম হল আম ঠাণ্ডার সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে। আমে থাকা ভিটামিন এ ও ডি ঠাণ্ডা বা ফ্লু জনিত সমস্যা দ্রুত উপসম করে।

১৪। স্কার্ভি প্রতিরোধে 

আমে থাকা ভিটামিন সি দাঁত, মাড়ি ও হাড়ের সুস্থতা রক্ষা করতে সাহায্য করে। তাই স্কার্ভি সমস্যা দূর করতে আমের কোন বিকল্প নাই। 

১৫। হৃদরোগের ঝুকি কমাতে

বর্তমানে হৃদরোগ একটি মহামারির মত ছড়িয়ে পরেছে। এই সমস্যা থেকে বাচার জন্য আম সহায়ক হতে পারে। আমের উপকারিতা হল হৃদপিণ্ডের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে আম সাহায্য করতে পারে। কারন আমে রয়েছে বিটা ক্যারোটিন, ভিটামিন এ, পটাশিয়াম ও ফাইবার যা শরীরের গ্লুকোজ, কোলেস্টেরল ও ওজন নিয়ন্ত্রনে রাখে।

১৬। ঘুমের সমস্যা সমাধানে

আমে থাকা ট্রিপটোফ্যান, মেলাটোনিন, ও ম্যাগনেসিয়াম আমাদের ঘুমকে ত্বরান্বিত করে। ফলে অনিদ্রা দূর হয়ে যায়।   

আমের বহুমুখী ব্যাবহার 

আমের উপকারিতা এখানেই শেষ নয়, আমের আরও নানাবিধ ব্যাবহার রয়েছে। নিম্নে আমের বহুমুখী ব্যাবহার তুলে ধরা হল, 

১। পাকা আমে ভিটামিন বি কমপ্লেক্স রয়েছে যা শরীরে স্নায়ু গুলোতে অক্সিজেনের সরবরাহ সচল রাখে

২। আম রক্ত স্বল্পতা দূর করতে সাহায্য করে

৩। প্রতিদিন আম খেলে শরীরের ক্ষয় রোধ করে।

৪। শরীরের রক্ত পরিস্কার করে। 

৫। অপুষ্টি জনিত সমস্যা দূর করে

৬। শরীরকে ঠাণ্ডা রাখতে সাহায্য করে

৭। আম স্নায়ু তন্ত্রের সুস্থতা বজায় রাখে

আমের উপকারিতা – ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য

গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কার্বোহাইড্রেটের সূচক হিসেবে ধরা হয়। আমের এই ইনডেক্স ৫০ এর অধিক। যেসকল খাবারে গ্লাইসেমিক রেট কম থাকে সে খাবার ততই স্বাস্থ্যের জন্য ভাল। 

আমাদের মধ্যে ভুল ধারনা হল ডায়াবেটিসের রোগীরা আম খেতে পারে না। কথাটি সঠিক নয়। তবে দুপুরে খাওয়ার পর বা রাতে আম খেলে রক্তে শর্করার পরিমান বারার সম্ভাবনা থাকে। 

তাই পুষ্টিবিদদের মতে সকালে নাস্তার সাথে আম খেলে দুপুরে খাবারের পরিমান কমিয়ে ফেলতে হবে। এতে অতিরিক্ত ক্যালরি কমিয়ে ফেলা সম্ভব। তবে আম খাওয়ার সবচেয়ে ভাল সময় হচ্ছে মধ্য সকাল অর্থাৎ সকালের নাস্তা ও দুপুরের খাবারের মাঝামাঝি সময়টা। 

একজন ডায়াবেটিস রোগী দৈনিক ৫০ থেকে ৬০ গ্রাম আম খেতে পারেন।

রূপচর্চায় আমের ব্যাবহার 

আম ত্বকের রুপচর্চায় অনেক উপকারী। কারন আমের কোন প্রতিক্রিয়া নেই ত্বকের উপর। বিভিন্ন উপায়ে আমের ব্যাবহার হয় ত্বকের যত্নে। 

১। দৈনিক আম খেলে ত্বকের উজ্জলতা বৃদ্ধি পায়

২। প্রতিদিন এক টুকরো আম দিয়ে ত্বকে মাসাজ করুন, এতে ত্বকে কাল ভাব দূর হবে।

৩। পাকা আম খেলে ব্রনের সমস্যা অনেকটা কমে যায়. পাকা আমের উপকারিতা তাই অনেক বেশি।

৪। ত্বক রোদে পুড়ে গেলে সে জায়গায় আমের ক্বাথ ও গুরা দুধ মিশিয়ে মেখে নিন। উজ্জলতা বৃদ্ধি পাবে

৫। ত্বকে কোন দাগ থাকলে সেই জায়গায় আমের রস দিয়ে মাসাজ করলে দাগ হালকা হয়ে যায়

আম খাওয়ার কিছু সতর্কতা 

১। আম খাওয়ার পূর্বে ভালভাবে ধুয়ে পরিস্কার করে নিতে হবে। 

২। আমের সাথে অতিরিক্ত লবন ও মরিচ খাওয়া ঠিক নয়। এতে পুষ্টিগুণ নষ্ট হয়।

৩। আম খাওয়ার পরে পানি খাওয়া উচিত নয়।

৪। প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত আম খেলে হজমের সমস্যা দেখা দিতে পারে। 

৫। কাঁচা আমের কষ অনেক ক্ষতিকর। মুখে বা পেটে গেলে বিভিন্ন ধরনের সংক্রমন হতে পারে। 

৬। আমে থাকা ইউরিশিয়াল নামক রাসায়নিক অনেকের জন্য অ্যালার্জি সৃষ্টি করতে পারে।

পরিশেষে 

আমরা সবাই কমবেশি আম খেতে ভালবাসি। তবে আমের উপকারিতা সম্পর্কে আমাদের তেমন কোন তথ্য জানা থাকে না। আমকে উপযুক্ত পরিমানে ব্যাবহার করলে অনেক উপকার পাওয়া যায়। কারন আমের যেমন পুষ্টিগুণ রয়েছে তেমনি ওষুধি গুনও রয়েছে। 

আম সম্পর্কিত প্রশ্ন ও উত্তর / FAQ

১। আম কখন খাওয়া ভালো?

উত্তরঃ আম খাওয়ার সবচেয়ে ভালো সময় হচ্ছে মধ্য সকাল অর্থাৎ সকালের নাস্তা ও দুপুরের খাবারের মাঝের সময়টা। এটা সবার ক্ষেত্রেই। যারা ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে চান বা ডায়াবেটিস যাদের আছে তারাও চেষ্টা করবেন মধ্য সকালে আম খেতে।

২। রাতে আম খেলে কি ক্ষতি হয়?

উত্তরঃ রাতের খাবার খাওয়া হয়ে গেলে এরপর আর আম খাবেন না। কারণ আম হলো ভারী ধরনের ফল। এতে ক্যালোরির মাত্রা থাকে অনেকটা বেশি। রাতে খাবার খাওয়ার পরে আম খেলে সেই খাবার হজম করতে সমস্যা হবে, সেইসঙ্গে বাড়তে পারে ওজনও।

৩। আমে কি কোলেস্টেরল বাড়ে?

উত্তরঃ ফলটি ম্যাঙ্গিফেরিন সমৃদ্ধ, এটি একটি সুপার অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা হার্টের স্বাস্থ্যের জন্য ভাল। গবেষণা অনুসারে, কাঁচা আম আপনার রক্তের কোলেস্টেরল, ট্রাইগ্লিসারাইড এবং ফ্রি ফ্যাটি অ্যাসিডের মাত্রা কমাতেও সাহায্য করে।  

আরও পড়ুন-

রংপুরের বিখ্যাত হাড়িভাঙ্গা আম

Leave a Comment