আয়কর রিটার্ন দাখিলের নিয়ম

আয়কর রিটার্ন 

একটি দেশের বাহ্যিক উন্নয়ন বা অভ্যন্তরীণ, সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী, অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ, নিরাপত্তা বাহিনীর (security forces) বেতন ভাতা সহ বিভিন্ন কাজের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের একটি বড় অংশই আয়কর থেকে আসে। প্রতিটি দেশের প্রতিটি নাগরিকেরই দায়িত্ব (Responsibility of citizens) আয়কর রিটার্ন দেওয়া।

নিজের সম্পত্তি ও আয় সম্পর্কে সরকারকে অবহিত করা এবং নাগরিকদের মধ্যে নির্দিষ্ট আয়কারী সকলেরই উচিত নিয়মিত আয়কর (tax return) দেওয়া। 

এই আর্টিকেলের মাধ্যমে আপনি দাখিলের নিয়ম সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন। আয়কর রিটার্ন দাখিলের নিয়ম (Income Tax Return) জানতে এই পুরো পোস্টটি মনোযোগ সহকারে পড়ুন। আমাদের সকলেরই উচিত নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আয়কর (income tax) জমা দেওয়া। অন্যান্য দেশের নিয়মের মতো বাংলাদেশেও ঠিকমতো আয় প্রদর্শন না করার জন্য জেল, জরিমানা গুনতে হয়। বাংলাদেশে প্রতিবছর বাৎসরিক আয় অনুযায়ী আয়কর প্রদান করতে হয়। 

কোন ব্যক্তির বাৎসরিক আয়ের (Annual income) আয়কর নিম্নসীমা অতিক্রম করলে প্রতি বছর কর প্রদান করতে হবে। তবে অবশ্যই যদি কোন ব্যক্তি আয় করের নিম্নসীমা অতিক্রম না করে, তাহলে তাকে জিরো ট্যাক্স (Zerotex) রিটার্ন দিতে হবে। তাই রিটার্ন (income tax) দাখিলের নিয়ম এর পাশাপাশি আয়করের হার ও সকল তথ্য করদাতাদের জেনে রাখা উচিত। 

আয়কর রিটার্ন দাখিলের সময় 

আয়কর অফিসে গিয়ে উপস্থিত থেকে আয়কর রিটার্ন (income tax) দাখিল করার কাজটি সম্পন্ন করতে হয়। আয়কর রিটার্ন দাখিল করা বলতে, নির্দিষ্ট নিয়ম অনুযায়ী ফরম পূরণ করা ও ফরমটি জমা দেওয়াকেই বুঝায়। বাংলাদেশের প্রত্যেক শ্রেণীর করদাতাদের রিটার্ন (tax return) দাখিলের জন্য আয়কর সার্কেল নির্দিষ্ট করা আছে। আয়কর (tax return) সম্পর্কিত সব ধরনের তথ্য করদাতার টিন সার্টিফিকেটে উল্লেখ করা থাকে। সেটা অনুযায়ী করদাতাকে এই নির্দিষ্ট সার্কেলের কর অফিসে উপস্থিত হয়ে সে রিটার্ন দাখিল করতে হয়।

আরও পড়ুনঃ Drop Shipping বিজনেস কী? ড্রপশিপিং ব্যবসা করার সুবিধা

আয়কর রিটার্ন দাখিলের জন্য কাগজপত্র 

আয়কর রিটার্ন (tax return) দাখিল করার জন্য নির্দিষ্ট ফরম ও বেশ কিছু কাগজপত্র তার সাথে যুক্ত করতে হয়। মূলত এই কাগজপত্র গুলো করদাতার আয়ের উৎস ও পরিমাণের প্রমাণ হিসেবে প্রয়োজনে পড়ে। রিটার্ন দাখিলের সময় করদাতাকে ভিন্ন ভিন্ন খাত অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন ধরনের কাগজপত্র প্রদর্শনের প্রয়োজন হতে পারে। রিটার্ন (tax return) দাখিল করার জন্য যেসব কাগজপত্র প্রয়োজন পড়ে খাত অনুযায়ী তার তালিকা হচ্ছে :-

বেতন খাত

১. বাৎসরিক আয়ের একটি অংশ ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত সুদ থেকে এসে থাকে তাহলে ওই ব্যাংক হিসাবের ব্যাংক বিবরণী সার্টিফিকেট। 

২.করদাতার বেতন বিবরণী। 

৩. কোন ধরনের বীমা প্রকল্পে যুক্ত থাকলে তার স্বপক্ষে প্রমাণাদি। 

গৃহ সম্পত্তি খাত

১. পৌর / সিটি / ভূমি রাজস্ব প্রদানের রশিদ। 

২. বাড়ির মালিকদের ক্ষেত্রে বাড়িভাড়ার চুক্তিনামা, প্রাপ্য বাড়ীভাড়া ব্যাংকে জমা রাখার ব্যাংক বিবরণী। 

৩. বাড়ি কেনা বা নির্মাণ কাজে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করে থাকলে ঐ ঋণের সুদের সমর্থনে ব্যাংক বিবরণীয় সার্টিফিকেট। 

নিরাপত্তা জামানতের সুদ খাত

১. আপনার সুদ আয় থাকলে সুদ প্রদানকারী কর্তৃপক্ষের প্রত্যয়ন পত্র।

২. রিটার্ন দাখিলের বছরে যদি কোন ধরনের বন্ড বা ডিবেঞ্জার কিনে থাকেন তবে তার ফটোকপি।

৩. কোন প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে বন্ড বা ডিভেঞ্জার কিনে থাকলে এই বিষয়ে যে ব্যাংক থেকে সুদ গ্রহণ করা হয়ে ওই ব্যাংকের সার্টিফিকেট বা প্রতিষ্ঠানের প্রত্যয়ন পত্র।

মূলধনী লাভ থেকে আয়ের খাত

১. পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ কোন কোম্পানি শেয়ার লেনদেনের মাধ্যমে আয় করে থাকলে সে সংক্রান্ত প্রত্যয়ন পত্র। 

২. যদি মূলধনী উৎসে আয়কর জমা হয়, তার চালানের ফটোকপি। 

৩. করদাতার স্থাবর সম্পত্তি বিক্রয়/হস্তান্তর হলে তার দলিলের কপি।

অন্যান্য উৎসের আয়ের খাত

১. কোন প্রতিষ্ঠান থেকে কেনা সঞ্চয়পত্র থেকে পাওয়া সুদের আয় থাকলে সঞ্চয়পত্র ভাঙ্গার সময় বা সুদ প্রাপ্তির সময় নেওয়া সার্টিফিকেটের কপি। 

২. অন্য কোন ধরনের খাত থেকে আয় থাকলে ঐ খাতে আয়ের উৎসের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র। 

৩. কোন প্রতিষ্ঠানে রাখা নগদ টাকার লভ্যাংশ খাতে আয় থাকলে ব্যাংক বিবরণী, ডিভিডেন্ট ওয়ারেন্ট কপি অথবা সার্টিফিকেট।

আরও পড়ুনঃ ডাচ বাংলা ব্যাংক একাউন্ট খোলার নিয়ম

আয়কর রিটার্ন দাখিল করার নিয়ম 

আয়কর রিটার্ন (tax return) দাখিল করার জন্য প্রথমেই রিটার্ন দাখিল এর ফরম সংগ্রহ করতে হবে। এছাড়াও প্রতিবছর নতুন করে নির্দিষ্ট কিছু আয়কর (income tax) ফরম দেওয়া হয়। নতুন অথবা পুরাতন যেকেউ নিকটস্থ আয়কর অফিস থেকে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে সংগ্রহ করতে পারবেন। তাছাড়া এখন বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তির যুগে অনলাইন থেকে ফরম ডাউনলোড করে, প্রিন্ট করে নিতে পারেন। নির্দিষ্ট আয়কর (income tax) অফিস থেকে ফরম সংগ্রহ করে সঠিক নিয়মে পূরণ করে নির্দিষ্ট আয়কর অফিসে গিয়ে জমা দিতে হবে। রিটার্ন ফরমের তথ্যগুলো পূরণের সময় আপনার ব্যক্তিগত আইনজীবীর পরামর্শ নিয়ে পূরণ করা ভালো। এতে করে সকল তথ্য সঠিকভাবে পূরণ হয়, এবং যথাযতভাবে রিটার্ন দাখিল করা সম্ভব হয়। 

অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিল করার নিয়ম 

বাংলাদেশ সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে দেশের সরকারি সকল কাজই অনলাইনে করার সুবিধা তৈরি করছেন। সেই অনুযায়ী ২০২১ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে অনলাইনে আয়কর রিটার্ন (online tax return) দাখিল করার ব্যবস্থা শুরু করা হয়েছে। করদাতাগন এই সুবিধার ফলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ওয়েবসাইট এর মাধ্যমে সহজেই কম্পিউটার (computer) অথবা মোবাইল ফোনের (mobile phone) মাধ্যমে ঘরে বসেই অনলাইনে রিটার্ন দাখিল করতে পারবেন।

অনলাইনে আয়কর (online tax return) দাখিলের ক্ষেত্রে করদাতাকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ওয়েবসাইটে গিয়ে নির্দিষ্ট কিছু প্রশ্ন উত্তর দিলেই হয়ে যাবে। অনলাইনে রিটার্ন দাখিল করার জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এই ওয়েবসাইটে প্রবেশ করতে হবে, https://etaxnbr.gov.bd। 

অনলাইনে রিটার্ন (online tax return) দাখিল এর সুবিধা হচ্ছে করদাতাকে আলাদা করে ফরম পূরণ করার ঝামেলা নিতে হবে না। অনলাইনে রিটার্ন দাখিলের জন্য প্রথমে আপনাকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ওয়েবসাইটে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। ওয়েবসাইটে রেজিস্ট্রেশন (website registration) করার জন্য করদাতাকে অবশ্যই তার টিন সার্টিফিকেট (tin certificate) তৈরি করে নিতে হবে। এবং প্রয়োজনে ব্যবহার করা লাগতে পারে তাই হাতের কাছে রাখতে হবে। রেজিস্ট্রেশন (registration) শেষ করে নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম কানুন মেনে রিটার্ন দাখিল করা যাবে।

আরও পড়ুনঃ দারাজ অনলাইন শপিং দারাজ থেকে পণ্য কেনার নিয়ম

আয়কর ও রিটার্ন দাখিলের জন্য ন্যূনতম আয় 

একটি নির্দিষ্ট আয়সীমার পর থেকে আয়কর (income tax) প্রদান করা বাধ্যতামূলক হয়ে যায়। আয়কর নিম্নসীমা এদেশের নারী-পুরুষ ও অন্যান্য কিছু বিশেষ ক্ষেত্রভেদে কিছুটা আলাদা রয়েছে, যেমন:-

৬৫ বছর বয়সের কম পুরুষ ব্যক্তির ক্ষেত্রে – বাৎসরিক আয় ৩,০০,০০০ (তিন লক্ষ) টাকার বেশি হলে উনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। 

স্বাভাবিক মহিলা এবং ৬৫ বছর বয়সের বেশি পুরুষ ব্যক্তির ক্ষেত্রে – বাৎসরিক আয় ৩,৫০,০০০ (তিন লক্ষ পঞ্চাশ হাজার) টাকার বেশি হলে আয়কর রিটার্ন প্রযোজ্য। 

প্রতিবন্ধী ব্যক্তির ক্ষেত্রে – বাৎসরিক আয় ৪,৫০,০০০ (চার লক্ষ পঞ্চাশ হাজার) টাকার বেশি হলে প্রযোজ্য। 

যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার ক্ষেত্রে – বাৎসরিক আয় ৪,৭৫,০০০ (চার লক্ষ পঁচাত্তর হাজার) টাকার বেশি হলে আয়কর রিটার্ন (tax return)  প্রযোজ্য। 

তাছাড়া ও প্রতিবন্ধীর সন্তান বা পালিত রয়েছে এরকম কোন পরিবারের ক্ষেত্রে আয়কর নিম্নসীমা বৃদ্ধি পাবে। 

শূন্য আয়কর রিটার্ন দাখিল করার নিয়ম 

শুন্য রিটার্ন (tax return) দাখিল করার পদ্ধতি সাধারণ আয়কর রিটার্ন দাখিলের মতো একই। স্বাভাবিক নিয়মেই শূন্য রিটার্ন দাখিল করার জন্য আবেদনকারীকে ব্যক্তি করদাতার জন্য নির্ধারিত ফরমে রিটার্ন দাখিল করতে হবে। পরে হিসাব অনুযায়ী করদাতার বাৎসরিক আয় আয়কর নিম্নশ্রেণীর নিচে থাকলে সেটা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই শূন্য আয়কর হিসেবে ধরা হবে ও করদাতার শূন্য রিটার্ন দাখিল করা হয়ে যাবে। 

কারা শূন্য রিটার্ন দাখিল করতে পারবেন 

যে কেউ শূন্য রিটান দাখিল করতে পারবেন না। শুধুমাত্র তারাই শূন্য রিটার্ন (tax return) দাখিল করতে পারবেন যাদের আয়কর নিম্নসীমার নিচে রয়েছে। অর্থাৎ, নির্দিষ্ট প্রয়োজনে যারা টিন সার্টিফিকেট তৈরি করেছেন, কিন্তু তাদের কর যোগ্য কোন আয় নেই, একমাত্র তারাই চাইলে শূন্য রিটার্ন দাখিল করতে পারবেন। 

শেষকথা 

প্রতিবছর নিয়ম অনুযায়ী আয়কর রিটার্ন (tax return) দাখিল করা প্রত্যেক করদাতাগনদের দায়িত্ব। রিটার্ন দাখিল করার প্রয়োজনীয় অনেক তথ্য আমাদের এই পোস্টে উল্লেখ করা হয়েছে। এই পুরো পোস্টটি মনোযোগ সহকারে পড়লে আশা করি আপনি কিছুটা হলে উপকৃত হবেন। রিটার্ন (income tax) দাখিল এর বিষয়ে সঠিক ধারণা না থাকায় অনেকেই ভুল করে জরিমানার সম্মুখীন হতে হয়। তাই অবশ্যই নির্দিষ্ট আয়কর অফিসে গিয়ে সঠিক তথ্য জেনে রিটার্ন (Income Tax Return) দাখিল করবেন। পুরো পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। 

আয়কর রিটার্ন সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন ও তার উত্তর / FAQ’s

১. আয়কর রিটার্ন কি ?

উত্তর:- করদাতার বার্ষিক আয়, ব্যয় ও সম্পদের তথ্য নির্ধারিত ফরমে উপস্থাপন করাই হচ্ছে আয়কর রিটার্ন। 

২. আপনার কি ইনকাম ট্যাক্স রিটার্ন জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক?

উত্তর:-আয় করযোগ্য হোক বা না হোক আপনি যদি ধারা ১৮৪(এ) অনুযায়ী টি আই এন গ্রহনে বাধ্য হয়ে থাকেন এবং ধারা ৭৫(২) এর অন্তর্ভুক্ত না হয়ে থাকেন তবে আপনাকে অবশ্যই আয়কর রিটার্ন জমা করতে হবে।

আরও পড়ুন- 

টিন সার্টিফিকেট কি? ই-টিন (E-TIN)কী, কেন ও কীভাবে করতে হয়?

ডাটা এন্ট্রি কি ? ডাটা এন্ট্রি করে কত টাকা আয় করা যায়

Leave a Comment