ঢেকুর কমানোর উপায়

ঢেকুর কমানোর উপায়

প্রতিদিন কমবেশি ঢেকুর আমদের সবারই ওঠে, এটি অস্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়। অনেকে-তো ভূরিভোজন সম্পন্ন করার পর তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন। তবে ঢেকুর যতক্ষণ পর্যন্ত স্বাভাবিক লেভেলে থাকে ততক্ষণই এটি স্বাভাবিক। যখন ঢেকুরের মাত্রা মাত্রাতিরিক্ত লেভেলে চলে যায় তখন আপনার সেই তৃপ্তির ঢেকুরই চরম অতৃপ্তিতে পরিণত হয়।

কিছু কিছু ক্ষেত্রে তো এই ঢেকুরের জ্বালায় দৈনন্দিন স্বাভাবিক জীবনপ্রবাহেও বিঘ্ন ঘটে। আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় ঢেকুর কমানোর উপায় সম্পর্কে। তাই আপনিও যদি ঢেকুর সমস্যায়

জর্জরিতদের লিস্টে থাকেন তবে অবশ্যই এর সমাধান সম্পর্কে জেনে নেওয়া জরুরি। কারণ সময় থাকতে এই ঢেকুর সমস্যার সমাধান না করলে তা পরবর্তীতে আপনার পাশাপাশি আপনার চারপাশে থাকা মানুষদেরও মহাবিরক্তির কারণ হয়ে উঠতে পারে। তাই আজ আমরা জেনে নিব কিভাবে নিজের ঢেকুরকে কন্ট্রোলে রাখা যায়। চলুন জেনে নেওয়া যাক ঢেকুর কমানোর উপায়।


আরও পড়ুনঃ গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা জানা জরুরী


ঢেকুর কেনো ওঠে 

ঢেকুর কমানোর উপায় খোঁজার আগে ঢেকুর ওঠার কারণসমূহ জেনে নেওয়া জরুরি। ফুসফুসের নিচে থাকা পাতলা মাংসপেশি (ডায়াফ্রাম) এর হঠাৎ সংকোচনের ফলেই ঢেকুর সৃষ্টি হয়। প্রাথমিকভাবে ঢেকুর ওঠার একশোরও বেশি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে এর মধ্যে অধিকাংশই ঢেকুরের জন্য সামান্যই দায়ী। ঢেকুর ওঠার কয়েকটি প্রধান কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা যেসব সমস্যা চিহ্নিত করেছেন সেগুলো হলো :

  • ঢেকুর ওঠার সবচেয়ে পরিচিত কারণ হলো দ্রুত খাবার গেলার চেষ্টা করা। দ্রুত খাবার খাওয়ার সময় খাবারের সাথে প্রচুর পরিমাণ হাওয়া পেটের মধ্যে প্রবেশ করে। এর ফলে “Vegas” নার্ভের কার্যকলাপে সমস্যার সৃষ্টি হয় এবং ঢেকুর আরম্ভ হয়
  • দীর্ঘসময় পানি পান না করার ফলে ঢেকুর আরম্ভ হতে পারে। কারণ দীর্ঘসময় পানি পান না করলে গলা শুকিয়ে যায়, এর ফলে ফ্রেনিক নার্ভ অতিরিক্ত উত্তেজিত হয়ে যায় এবং ফলশ্রুতিতে ঢেকুর শুরু হয়
  • অতিরিক্ত ঝাল খাওয়ার ফলেও ঢেকুর দেখা দিতে পারে। কারণ অতিরিক্ত ঝাল মানুষের ফ্রেনিক নার্ভকে উত্তেজিত করে তোলে এবং ডায়াফ্রামের সংকোচন-প্রসারণের হার বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে ঢেকুর আরম্ভ হয় 
  • এছাড়াও পাকস্থলীয় কোনো খাদ্য অথবা রস শারীরবৃত্তীয় কোনো কারণে খাদ্যনালিতে এসে পড়ার কারণেও ঢেকুর আরম্ভ হতে পারে 
  • পেটে গ্যাস হলেও ঢেকুর উঠতে পারে। পেটে গ্যাস হলে কোষ্ঠকাঠিন্যের মতো সমস্যা দেখা দেয় যা পরোক্ষভাবে ঢেকুর আরম্ভ করতে সাহায্য করে 
  • আচমকা স্নায়ু প্রতিক্রিয়ার ফলেও ঢেকুর আরম্ভ হতে পারে। যেমন: অতিরিক্ত হাঁসা, হঠাৎ ভয় পাওয়া, অতিরিক্ত আবেগি হয়ে পড়া ইত্যাদি নানা কারণে ঢেকুর আরম্ভ হতে পারে 
  • চেতনানাশক ঔষধ, উত্তেজনাবর্ধক ঔষধ, ওপিয়েট জাতীয় ঔষধ, অ্যালকোহল, কোমল পানীয় ইত্যাদি সেবনের ফলেও ঢেকুর দেখা দিতে পারে 
  • কিছু কিছু ক্ষেত্রে কোনো কারণ ছাড়াই ঢেকুর আরম্ভ হয়ে যায়। তবে এটি সম্পূর্ণই স্বাভাবিক একটি বিষয়। কারণ শারীরবৃত্তীয় নানা কারণে স্বাভাবিকভাবেই ঢেকুর আরম্ভ হতে পারে। তবে ঘন ঘন ঢেকুর দেখা দিলে সেক্ষেত্রে শারীরিক জটিলতার সম্ভাবনা রয়েছে।

ঢেকুর কমাতে যা খাবেন

ইতোমধ্যেই ঢেকুর ওঠার কারণসমূহ জেনে গিয়েছেন। এই কারণ সমূহকে চিহ্নিত করে বিশেষজ্ঞরা নির্দিষ্ট কিছু খাবারের তালিকা তৈরি করেছেন যা গ্রহন করলে ঢেকুর উপশম করা সম্ভব। নিয়ম মেনে এসব খাবার গ্রহন করলে আপনার ঢেকুর সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। ঢেকুর কমানোর উপায় মোতাবেক যা যা খাবেন: 

টক দই

টক দই ঢেকুর সমস্যা সমাধানে কার্যকরী ভুমিকা পালন করে। টক দইয়ে থাকে “প্রোবায়োটিক” যা অন্ত্রে অবস্থান করা ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা নিয়ন্ত্রনে সাহায্য করে। অন্ত্রে থাকা ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা অনিয়ন্ত্রিত হলে তা গ্যাস সৃষ্টি করে। আর গ্যাস সৃষ্টি হলেই ঢেকুর দেখা দিতে পারে। পাশাপাশি টক দই খাবার হজমেও ভালো ভূমিকা রাখে যা ঢেকুর উপশমের ক্ষেত্রে খুবই কার্যকরি।


আরও পড়ুনঃ ডায়াবেটিস রোগীর খাদ্য তালিকা


পেঁপে 

দৈনিক পেঁপে খেলে পেট পরিষ্কার থাকে এবং পেটে গ্যাস তৈরি হয়না। এর ফলে ঢেকুর ওঠার সম্ভাবনা অনেক বেশি কমে যায়। তাই পাঁকা অথবা আধ-পাঁকা পেঁপে খেলে একদিকে হজমক্রিয়া উন্নত হয় অন্যদিকে ঢেকুর আসা কমে যায়। 

জিরে

শুকনো জিরে সেবনের ফলে ঢেকুর কমতে পারে। জিরে খাদ্য হজম করতে সাহায্য করে পাশাপাশি গ্যাস নিষ্কাশনেও ভুমিকা পালন করে। তাই প্রতিদিন জিরে চিবিয়ে খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। চাইলে জিরে ভেজে গুড়ো করে হালকা গরম পানিতে মিশিয়েও সেবন করতে পারেন।

পুদিনা পাতা 

পুদিনা পাতায় থাকে অ্যান্টিস্পাসমোডিক এলিমেন্টস যা হজমকার্যে সহায়তা করার পাশাপাশি পেটে গ্যাস জমা আটকাতে সাহায্য করে। সেইসাথে পাঁচক রসের কার্যকরিতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে পুদিনা পাতা। তাই ঢেকুর কমাতে চাইলে প্রতিদিন পুদিনা পাতা গ্রহণের অভ্যাস গড়ে তুলুন। যদিও অনেকের পক্ষেই সরাসরি পুদিনা পাতা খাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাই এক চামচ পরিমাণ পুদিনা পাতা একধাপ গরম পানিতে নিয়ে তা ১০ মিনিট ভিজিয়ে রাখুন। এরপর সেই পানি পান করুন। এতেই কাজ হয়ে যাবে। 

এলাচ

এলাচে থাকে কারমিনেটিভ উপাদান যা হজমক্রিয়া বেগবান করার পাশাপাশি পেটের সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে। ঢেকুর রোধে এলাচের বিশেষ জুড়ি রয়েছে। পেটে জমে থাকা গ্যাস অপসারণেও এলাচ ভুমিকা রাখে। তাই প্রতিদিন দুই তিনটে আস্ত এলাচ চিবিয়ে খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। 

মৌরি 

এলাচের মতো মৌরিতেও কারমিনেটিভ উপাদান থাকে। হজমে সহায়তা করার পাশাপাশি অপাচ্য গ্যাস অপসারণ, বুক জ্বালাপোড়া প্রশমনেও মৌরি কার্যকরি ভুমিকা পালন করে। তাই প্রতিদিন মৌরিবীজ গ্রহন করলে ঢেকুর হতে নিস্তার পাওয়া যায়। মৌরিবীজ খাওয়ার উত্তম সময় হলো দুপুর অথবা রাতের খাবারের ঠিক পরে। তাই প্রতিদিন নিয়ম করে ভাজা মৌরিবীজ গ্রহন করার চেষ্টা করুন। 

ক্যামোমাইল ফুলের চা

ক্যামোমাইল ফুলের চা, সংক্ষেপে ক্যামোমাইল চা সেবনের মাধ্যমেও ঢেকুর কমানো যেতে পারে। ক্যামোমাইল ফুল শুকিয়ে তৈরি করা হয় এই বিশেষ সুগন্ধি চা। এই চা পান করলে একদিকে ঠিকঠাক ঘুম হয় অন্যদিকে হজম শক্তি বৃদ্ধি পায়। ক্যামোমাইল চা গ্রহনের ফলে পেটে জমে থাকে গ্যাস ঢেকুরের মাধ্যমে না বেড় হয়ে শারীরিক নিয়মে শরীর থেকে বেড়িয়ে যায়। তাই প্রতিদিন অন্তত দুই কাপ ক্যামোমাইল চা পান করার অভ্যাস গড়ে তুলুন।


আরও পড়ুনঃ কোলেস্টেরল কমানোর উপায়


ঢেকুর কমানোর উপায়-  কিছু বিশেষ করণীয় 

ইতোমধ্যেই আপনারা ঢেকুর কমানোর বিভিন্ন খাবার সম্বন্ধে জেনে গিয়েছেন। তবে এসব খাবার ছাড়াও আরো বিশেষ কিছু উপায় অবলম্বনের মাধ্যমে ঢেকুর কমানো যায়। ঢেকুর কমাতে হলে নিজের অভ্যাসগত বেশ কিছু পরিবর্তন আনা জরুরি। নিম্নে ঢেকুর কমানোর বিশেষ করণীয়গুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:

  • ধীরে-সুস্থে ভালোভাবে চিবিয়ে খাবার গ্রহন করতে হবে। এর ফলে খাবার ঠিকভাবে হজম হয় এবং খাবারের সাথে অতিরিক্ত বাতাস পেটের ভিতরে প্রবেশ করতে পারে না। ফলে ঢেকুর ওঠার সম্ভাবনা কমে যায় 
  • লাঞ্চ অথবা ডিনার করার পর বাইরে গিয়ে ১০ থেকে ১৫ মিনিট হাঁটাহাঁটি করার অভ্যাস গড়ে তুলুন। এর ফলে পেটে থাকা খাবার ভালোভাবে হজম হয় এবং পেটে গ্যাস জমতে পারেনা। ফলে ঢেকুর ওঠার কোনো সম্ভাবনা থাকেনা
  • অতিরিক্ত তেল-মসলাযুক্ত এবং অতিরিক্ত ঝালযুক্ত খাবার পরিহার করুন। এসব খাবার একদিকে আপনার স্বাস্থ্যের অবনতিতে ভুমিকা রাখে অন্যদিকে ঢেকুরের জ্বালা বাড়িয়ে দেয়। তাই ঢেকুর কমাতে হলে অবশ্যই এসব অস্বাস্থ্যকর খাবার হতে দূরে থাকতে হবে 
  • বেশি রাত হলে দুধ,কলা খাওয়া থেকে বিরত থাকুন, কারণ গভীর রাতে দুধ অথবা কলা খাওয়ার কারণে অনেকের অ্যাসিডিটি বেড়ে যেতে পারে। অ্যাসিডিটি বাড়ার সাথে ঢেকুর ওঠার যোগসূত্র রয়েছে। তাই রাত বেশি হলে দুধ, কলা না খাওয়াই ভালো
  • অসময়ে চা এবং কফি পান করা থেকে বিরত থাকুন। এর ফলে পেটে গ্যাসের সমস্যা হতে পারে। যাদের বয়স বেশি তাদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা বড় আকারে দেখা যায়। অসময়ে চা-কফি পান করলে টক ঢেকুর ওঠার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। তাই অসময়ে চা-কফি পান করবেন না
  • যারা দীর্ঘদিন ধরে ঢেকুর সমস্যায় জর্জরিত তাদের জন্য সর্বোত্তম উপায় হলো বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করা এবং ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা।

শেষকথা

ঢেকুর ওঠার মতো সমস্যাকে আপাতদৃষ্টিতে ছোট বলে মনে হলেও কারো কারো ক্ষেত্রে এই সমস্যা প্রকট হয়ে দাড়ায়। ঢেকুরের শব্দে আশেপাশের মানুষজন বিরক্ত হয়। কেউ কেউ তো আবার কটুকথা শুনিয়ে দেয়। এছাড়াও অনবরত ঢেকুর ওঠার ফলে নিজের স্বাভাবিক কাজকর্মেরও বিঘ্ন ঘটে। তাই যাদের এই সমস্যা রয়েছে তাদের তাচ্ছিল্য না করে এই সমস্যা সমাধানের উপায় দেখিয়ে দিন।

উপরে উল্লেখিত উপায়সমূহ সঠিকভাবে মেনে চললে ঢেকুর কমে যাবে। যদিও কারো কারো ক্ষেত্রে এলার্জিজনিত অথবা অন্য কোনো শারীরবৃত্তীয় সমস্যার কারনে ঢেকুর সমস্যা হতে পারে। সেক্ষেত্রে এসব উপায় অবলম্বনেই ঢেকুর হতে মুক্তি পাওয়া নিয়ে সংশয় রয়েছে। এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিয়েই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।

ঢেকুর কমানোর উপায় সম্পর্কিত প্রশ্ন ও উত্তর / FAQ’s

১/ কোন কোন রোগের কারণে ঢেকুর সমস্যা দেখা দিতে পারে? 

উত্তর: কিডনি ফেল, স্ট্রোক, মাল্টিপল স্কেরোসিস, মেনিনজাইটিস ইত্যাদি শারীরিক সমস্যার পড়ে ঢেকুরের সমস্যা দেখা দিতে পারে। 

২/ মদ্যপান করলে ঢেকুর ওঠার সম্ভাবনা আছে?

উত্তর: অবশ্যই, অতিরিক্ত মদ্যপান করলে ঢেকুর দেখা দিতে পারে। 

৩/ স্বাভাবিকভাবে ঢেকুর ওঠার পর তা কতক্ষণের মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়? 

উত্তর: যদি স্বাভাবিকভাবেই কারো ঢেকুর ওঠে তবে আপনাআপনিই তা ঠিক হয়ে যায়। এক্ষেত্রে মিনিটখানেকের মতো সময় লাগতে পারে। 

৪/ তাতক্ষনিকভাবে ঢেকুর উপশমের উপায় কি?

উত্তর: তাতক্ষনিকভাবে ঢেকুর উপশমের সবচেয়ে পরিচিত টোটকা হলো বেশি বেশি পানি পান করা। এছাড়াও শুকন কোনো খাবার খেয়ে দেখতে পারেন। এর মাধ্যমেও তাতক্ষণিকভাবে ঢেকুর বন্ধ করা যায়।

আরও পড়ুন-

মধু খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা

ডিপ্রেশন থেকে মুক্তির উপায়

Leave a Comment