প্রেগন্যান্সির লক্ষণ কি কি দেখা যায়

প্রেগন্যান্সির লক্ষণ কি কি

একজন পূর্ণ বয়স্ক নারীর কাছে তার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর ও সুখময় অনুভূতি হলো মাতৃত্ব। মাতৃত্বে স্বাদ পাওয়ার জন্য নারীরা যেন মুখিয়ে থাকে। আর মাতৃত্বেরই প্রথম ধাপ হলো গর্ভধারণ যে মাতৃত্বে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি পর্যায়।

তবে অনেক নারীরাই জানেন না প্রেগন্যান্সির লক্ষণ কি কি এবং গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা-তে কোন কোন ধরনের খাবার রাখা অত্যন্ত জরুরি। একজন নারীর জীবনকালে গর্ভধারণ ও গর্ভবতীকালীন সময় অনেক সংবেদনশীল একটি পর্যায়।

এই পর্যায়টি একজন নারীর জীবনে দীর্ঘস্থায়ী শারীরিক পরিবর্তন ঘটায় যেটি তার মানসিক স্বাস্থ্যতেও প্রভাব ফেলে। আর এর কারণে তার সামাজিক জীবনেও বেশ বড় পরিবর্তন আসে। এজন্য এ পর্যায়টি একাধারে শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক জীবন নির্বিশেষে বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

এই কারণে এই সময় সাবধানতা বজায় রাখার জন্য প্রেগন্যান্সির লক্ষণ কি কিদেখা যায়, গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা-তে কোন কোন ধরনের খাবার রাখা প্রয়োজন সম্পর্কে জেনে রাখা সকলের জন্য জরুরি। এজন্য আজকে আমরা আলোচনা করবো এবং জানবো প্রেগন্যান্সির লক্ষণ কি কি দেখা যায় গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা সম্পর্কে:-

গর্ভবতী হলে কি কি লক্ষন দেখা দেয় সে সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো

আরও পড়ুনঃ নরমাল ডেলিভারি হওয়ার কার্যকারী টিপস?

সুস্থ প্রেগন্যান্সির লক্ষণ

মানুষের শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের রাখার প্রাকৃতিক একটি পন্থা হচ্ছে শরীরে ঘাম হওয়া। তবে গর্ভবস্থায় নারীদের শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায় এবং স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি গরম লাগে। যেহেতেু এ সময় একজন মানুষের শরীরের অভ্যন্তরে আরও একটি মানব শরীর বেড়ে ওঠে সেহেতু এইটুকু পরিবর্তন খুব স্বাভাবিক।

মানুষের শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৯৮.২ ডিগ্রি ফারেনহাইট কিন্তু গর্ভকালীন সময়ে সেটি বেড়ে গিয়ে ৯৮.৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট হয়ে থাকে। সাধারণত ওভ্যুলেশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার ২০ দিন পর থেকে এই ধরনের পরিবর্তন লক্ষ করা যায় যেটি নারীদের জীবনে নতুন অধ্যায় শুরুর ইঙ্গিত দেয়। এ সময় নারীদের শরীরে এমন পরিবর্তন আসার পেছনে কিছু কারণ দায়ী। সেগুলো নিচে উল্লেখ করা হলো –

শরীরে হরমোনাল পরিবর্তন

গর্ভাবস্থায় নারীদের শরীরে স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি হরমোনাল পরিবর্তন ঘটে। বিশেষ করে এ সময় নারীদের শরীরে প্রোজেস্টেরন হরমোনের স্তরের বৃদ্ধি ঘটে যে কারণে শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেড়ে যায়।

মেটাবলিজম বেড়ে যাওয়া

অন্য সময়ের তুলনায় গর্ভকালীন সময়ে নারীদের শরীরে ক্যালরী স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি খরচ হয়। কারণ এ সময়টাতে একজন নারীর শরীর তার এবং তার গর্ভজাত শিশু উভয়ের জন্য কাজ করে যে কারণে স্বাভাবিকের তুলনায় ক্যালরী বেশি খরচ হয় এবং তার শরীরে মেটাবলিজমও তুলনামূলক বেড়ে যায়। এই জন্য স্বাভাবিকের চেয়ে শরীরে তাপমাত্রার বৃদ্ধি ঘটে।

শরীরে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি

এ সময় শরীরে রক্ত সঞ্চালন ‍বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে গর্ভধারনের তিন মাসকালীন সময়ে রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিকের চেয়ে ৫০ শতাংশ বেড়ে যায় যেটি শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধির একটি অন্যতম কারণ।

ওজন বেড়ে যাওয়া

গর্ভকালীন সময়ে নারীদের শরীরে ওজন তুলনামূলক হারে স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায় এবং এটিও শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং অতিরিক্ত গরম লাগার একটি অন্যতম কারণ।

পিরিয়ড মিস হওয়া

নারী শরীরের জৈবিক চক্রের অন্যতম একটি অংশ হলো পিরিয়ড (মাসিক)। সাধারণত একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর (বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ২৮ দিন পর) এটি চক্রাকারে ফিরে আসে। তবে ব্যাক্তি বিশেষে এই সার্কেলের কম বেশি হয়ে থাকে। তবে স্বাভাবিক সেই সময় অতিক্রম হয়ে যাওয়ার পরেও যদি পরিয়ড না হয় তাহরে সেটিকে গর্ভধারণের একটি লক্ষন হিসেবে গণ্য করা হয়।

তবে অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায় গর্ভবতী হওয়ার পরেও অনেক নারী পিরিয়ড মিস করেন না। এটি একটি ব্যাতিক্রমী লক্ষণ।

খাবারে অরুচি হওয়া

গর্ভধারণের প্রথম দিকে এই লক্ষণটি সাধারণত দেখা দিয়ে থাকে। বিশেষ করে এই সময়ে নারীরা এক বা একাধিক জিনিস খেতে পারেন না। মূলত পেঁয়াজের গন্ধ বা মাছের অথবা ডিমের গন্ধ তারা সহ্য করতে পারেন না। শরীরে ইস্ট্রোজন হরমোন বেড়ে যাওয়ার কারণে এমন সাইড ইফেক্ট দেখা দেয় বলে ধারণা করা হয়।

মর্নিং সিকনেস

গর্ভবতী হওয়ার অন্যতম লক্ষণ এটি। শতকরা ৮০ জন নারীর গর্ভবতী হওয়ার ৩ থেকে ৬ সপ্তাহের মধ্যে এই লক্ষণাট দেখা দেয়। এ সময় অ্যাস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরনের স্তর বেড়ে যাওয়ার কারণে সকাল বেলা গা গোলায় এবং বমি বমি ভাব হয়। এটি প্রথম দিকে সকাল বেলা দেখা দিলেও পরবতীর্তে আস্তে আস্তে বৃদ্ধি পায় এবং দিনের যে কোনো সময় এই রকম অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়। যেহেতু এটি প্রথম দিকে সকাল বেলা দেখা দেয় তাই এটিকে মর্নিং সিকনেস বলে।

ভ্যাজাইনাল ডিসচার্জ বা সাদা স্রাব

ভ্যাজাইনা দিয়ে প্রাকৃতিকভাবে যেই স্রাবটা বের হয়, সেটাই ভ্যাজাইনাল ডিসচার্জ বা সাদা স্রাব। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মিউকাস বের হয়ে ভ্যাজাইনার মৃত কোষ, অনিষিক্ত ডিম্বাণু ও ব্যাকটেরিয়া বের করে দেয় যা ইনফেকশন প্রতিরোধ করে। গর্ভাবস্থায় এই ভ্যাজাইনাল ডিসচার্জ বা সাদা স্রাব স্বাভাবিকের তুলনায় বেড়ে যায়।

গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে এটি পাতলা তরল এবং গন্ধহীন অবস্থায় থাকে। কিন্তু সময় অতিক্রম হওয়ার সাথে সাথে বিশেষ করে গর্ভকালীন সময়ের শেষের দিকে এটি ঘন ও আঠালো হয়ে যায় এবং এতে জেলীর মতো শ্লেষ্মা থাকতে পারে।

আরও জানুনঃ  সিজার অপারেশন কিভাবে করা হয়

ব্রেস্টের লক্ষ্যণীয় পরিবর্তন

ব্রেস্টের পরিবর্তন গর্ভকালীন সময়ের পরিবর্তন গুলোর মধ্যে অন্যতম একটি। National Institute of Child Health and Human Development এর মতে গর্ভধারণ এর ১ সপ্তাহ বা ১৫ দিনের মধ্যেই ব্রেস্টের পরিবর্তন শুরু হয় এবং সেটি লক্ষ্যও করা যায়। এ সময় ব্রেস্টে তীক্ষ্ণ ব্যথা হতে পারে।

এছাড়াও গর্ভাবস্থার শুরুর দিকে ব্রেস্টে ভারী ও চাপা ভাব অনুভূত হতে পারে। আবার কিছু সময় অতিক্রম হওয়ার পরে ব্রেস্ট বৃন্ত দিয়ে দুধের মতো হলুদ অথবা সাদা রঙের আঠালো তরল নিঃসৃত হতে পারে এবং ব্রেস্ট বৃন্ততে ব্যথাও অনুভূত হতে পারে।

গর্ভবতী হলে কি কি লক্ষণ দেখা যায়

মাথা ঘোরা

গর্ভাবস্থার একদম প্রাথমিক পর্যায়ের লক্ষণ হলো মাথা ঘোরা। গর্ভধারণের পর থেকেই নারীদের শরীরে নানা রকম পরিবর্তন শুরু হয় এবং তারই বহিঃপ্রকাশ মাথা ঘোরা। এ সময় শরীরে অভ্যন্তরে অনেক হরমোনাল চেঞ্জ হতে শুরু করে পাশাপাশি শরীর দুর্বল হয়ে যায় যে কারণে মাথা ঘোরে।

মুড সুইং

গর্ভাবস্থায় মুড সুইং বেশ সাধারণ একটি লক্ষণ। এটিকে Early Pregnancy Symptom-ও বলা হয়। এ সময় নারীদের মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকে। শরীরে ঘটতে থাকা হরমোনল পরিবতর্নের জন্য এমনটা ঘটে থাকে।

গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা

গর্ভকালীন সময় নারীদের জীবনে সবচেয়ে সেনসিটিভ সময়কাল। এ সময় শরীরে বিশেষ পরিবর্তন ঘটে যে কারণে এই সময়টাতে গর্ভবতী মায়ের খাবারের প্রতি বিশেষ লক্ষ রাখতে হয়। নিচে গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা দেয়া হলো:

১ থেকে ৩ মাসের গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা

গর্ভবস্থার প্রথম দিকে গর্ভবতী মায়েদের অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ করার প্রয়োজন পরে না। এ সময় দৈনন্দিন সাধারণ খাবারই গ্রহণ করা যেতে পারে তবে বোঝার সুবির্ধাথে একটি খাদ্য তালিকা নিচে দেওয়া হলো: 

খাবারের নামখাবার গ্রহণের পরিমাণ
ভাত২ থেকে ৩ কাপ/ ৫০০-৬০০ গ্রাম
ডিম১টি (৭০ ক্যালরী)
মাছ/মাংস৫০ গ্রাম
ডাল৪০০ গ্রাম
সবুজ সবজি এবং শাক৩৫০ গ্রাম
ঋতুভিত্তিক ফল২৫০ গ্রাম

এখানে প্রায় ১৫০০ ক্যালরী হিসেবে খাবারের তালিকাটি দেয়া রয়েছে। উল্লেখ্য খাবারে অতিরিক্ত তেল ব্যবহার করা যাবে না। খাবারে অতিরিক্ত তেল ব্যবহার করা গর্ভবতী মায়েদের স্বাস্থের জন্য ক্ষতিকারক।

৪ থেকে ৬ মাসের গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা

এ সময় পূর্ববতী মাস গুলোর চেয়ে একটু বেশি পরিমাণে খাবার গ্রহণ করতে হবে। ওপরের দেওয়া ১৫০০ ক্যালরীর তালিকার সাথে ৩৫০ ক্যালরী অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ করতে হবে। এ সময় খাবারে প্রোটিন জাতীয় খাবার যেমন: ছোলা, বাদাম, বীজ ইত্যাদি বেশি পরিমাণে রাখতে হবে। পাশাপাশি দুগ্ধ জাত খাবার, সুষম খাদ্য এবং ভিটামিন ডি ও ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবারও গ্রহণ করতে হবে।

৭ থেকে ৯ মাসের গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা

এ সময় পূর্ববতী মাস গুলোর চেয়ে আরও একটু বাড়িয়ে বেশি পরিমাণে খাবার গ্রহণ করতে হবে। উক্ত মাসগুলোতে পূর্বের মাসের চেয়ে ৪৫০ ৩৫০ ক্যালরী খাবার অতিরিক্ত গ্রহণ করতে হবে। আর এ সময়কালীন খাবার তালিকাতে আয়রন, ফ্যালিক এসিড, ভিটামিন সি, ম্যাগনেসিয়াম, ফাইবার এবং ডি এইচ এ সমৃদ্ধ খাবার রাখতে হবে।

গর্ভবতী মায়ের বর্জনীয় খাবার

যেহেতু গর্ভাবস্থায় শরীর অনেক সংবেদনশীল থাকে। তাই এ সময় গর্ভবতী মায়েদের খাবার গ্রহণ সম্পর্কে অনেক সচেতন হতে হভে এবং এ সময় এম নকিছু খাবার রয়েছে যা বর্জন করতে হবে-

  • রোড সাইড ফুড: রোড সাইড ফুড সকলেরই ভালো লাগে, কিন্তু এই খাবার গুরো অনেক অস্বাস্থ্যকর এবং পুষ্টিহীনও বলা চলে। তাই গর্ভাবস্থায় এই খাবার গুলো খাওয়া যাবে না। 
  • অধিক চিনি সমৃদ্ধ খাবার: অধিক পরিমাণে চিনি রয়েছে এমন খাবার গর্ভজাত বাচ্চার জন্য ক্ষতিকর। এ কারণে অধিক চিনি সমৃদ্ধ খাবার অব্যশই বর্জন করতে হবে।
  • প্রিজারভেটিভ খাবার: টিন জাত বা প্রিজারভেটিভ খাবারে এমন কিছু রাসায়নিক উপাদান যুক্ত করা হয় যা তাদের শেল্ফ লাইফ বাড়াতে সাহায্য করে। এ রাসায়নিক উপাদানগুলো শরীরের জন্য ক্ষতিকারক। এ জন্য এ ধরনের খাবার গর্ভাবস্থায় বর্জন করা বাঞ্ছনীয়।
  • ক্যাফেন জাতীয় খাবার: ক্যাফেন আছে এমন খাবার গর্ববতী নারীদের জন্য ক্ষতিকারক। কারণ ক্যাফেন এমন একটি জিনিস যার জন্য শরীরে পানি স্বল্পতা হওয়ার আশংকা থাকে। তাই গর্ভবতী মায়েদের ক্যাফেন জাতীয় খাবার তাদের খাবার তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে।

শেষকথা

আশা করছি উপরের আলোচনা থেকে প্রেগন্যান্সির লক্ষণ কি কি দেখা যায় এবং গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। তবে এরপরেও কোনো বিষয়ে কনফিউশন থেকে থাকলে অবশ্যই সে ক্ষেত্রে ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হবেন।

আরও পড়ুন-

বাচ্চা নেওয়ার সঠিক পদ্ধতি

গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা 

Leave a Comment