পাইলস এর ঘরোয়া চিকিৎসা

পাইলস এর ঘরোয়া চিকিৎসা

আজ আমরা পাইলস এর ঘরোয়া চিকিৎসা নিয়ে কথা বলতেই আমি হাজির হয়েছি আপনাদের কাছে , যাতে করে কি কারনে কি হচ্ছে তা খুব সহজেই আপনারা জানতে পারবেন। প্রথমে খুব সহজ করে বুঝিয়ে বলি পাইলস কি? কেন হয় এবং এর ঔষধ কিভাবে গ্রহণ করতে হবে।

পায়খানা করার সময় ব্যথা করে রক্ত যায় গোটা গোটা কি যেন দানার মতো বোঝা যায়, কি হল আমার বা এর সমাধান কি? আমি এমন অনেক রোগী দেখেছি দীর্ঘদিন ধরে এই রোগে ভোগার পরেও আর না পেরে তবে ডাক্তারের কাছে যান।

কারণ এই রোগটা নিয়ে কথা বলতে আমরা অনেকেই লজ্জা পাই ডাক্তারের কাছে যেতে চাই না। তাই ক্রমশ এই রোগটি জটিল হতে থাকে। প্রথমে বুঝিয়ে বলি পায়ুপথে কি হচ্ছে, পায়ুপথ বলতে বুঝায় শরীর থেকে  যেদিক দিয়ে পায়খানা বের হয়ে যায়। পায়ুপথের মুখ সাধারণত বন্ধ থাকে, আমাদের যখন প্রয়োজন হয় আমরা চাপ দিয়ে পায়ুপথের মুখ খুলে পায়খানা বা মল বের, করি সেখানে বেশ কিছু জিনিস একসাথে কাজ করে।

তার মধ্যে একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হল এনাল ফিসার। এগুলো থেকে চাপ দিয়ে পায়ুপথের মুখ বন্ধ রাখতে সাহায্য করে। যদি কোন কারণে তিনদিকে কুশন গুলো ফুলে যায় এগুলো থেকে রক্তক্ষরণ হয় বা সেগুলো নিচের দিকে নেমে যায় পায়ুপথের চারদিকে গোটা গোটার মতো দেখা যায় তখন সেটাকে আমরা পাইলস বা অর্শ নামে চিনি। মেডিকেলের ভাষায় এর নাম হলো HEMORRHOIDS.

পাইলস

পাইলস সাধারনত ২ প্রকার হয়ে থাকে এই  প্রকারভেদ নিচে উল্লেখ করা হলঃ

  1. অভ্যন্তরীণ পাইলস
  2. বাহ্যিক পাইলস

অভ্যন্তরীণ পাইলস এবং বাহ্যিক পাইলস পায়খানারদ্বারে তাদের অবস্থানের উপর ভিত্তি করে। এগুলি সাধারণ এবং মলদ্বারের ভিতরে মলদ্বার খোলার উপরে ২ থেকে ৪ সেমি এর মধ্যে ঘটে।

অভ্যন্তরীণ পাইলস:

অভ্যন্তরীণ পাইলসকে আবার চারটি পর্যায়ের হয় যা প্রোল্যাপের উপর ভিত্তি করেঃ

প্রথম পর্যায় – পাইলস ফুলে বাইরের দিকে বের হয়ে আসে না।
দ্বিতীয় পর্যায় – মলমূত্র ত্যাগের পর পাইলস ফুলে বাইরের দিকে বের হয়ে আসে এবং তারপর আপনা-আপনি ঠিক হয়ে যায়।
তৃতীয় পর্যায় – পাইলস ফুলে বাইরের দিকে বের হয়ে আসে এবং নিজে নিজে ঠিক করতে হয়।
চতুর্থ পযার্য় – পাইলস ফুলে বাইরের দিকে প্রলেপস হয় এবং তা আর নিজে ঠিক করা যায় না।

বাহ্যিক পাইলস:

বাহ্যিক পাইলস মলদ্বারের বাইরের প্রান্তে ছোট ছোট গলদ গঠন করে। এগুলো প্রায়শই চুলকানিদায়ক এবং বেদনাদায়ক হয়ে থাকে।

পাইলস হলে কি কি সমস্যা হয়

পায়খানার সাথে রক্ত যেতে পারে উজ্জ্বল লাল রঙের রক্ত

 সাধারণত টয়লেট পেপার ব্যবহার করার পরে দেখা যায় সেখানে  রক্ত লেগে আছে অথবা  পায়খানার প্যান এর গায়ে দেখা যায় রক্ত। উজ্জ্বল লাল রক্ত কেন বের হয়? পায়খানা বের হওয়ার পথে একদম শেষের দিকের কৌশলগুলোর থেকে রক্ত বের হয়েছে। সেই রক্ত এখনও তাজা জমাট বাঁধার সুযোগ পায়নি, উজ্জ্বল দেখা যায়।

পক্ষান্তরে রক্তক্ষরণ যদি আগেই হতো পাকস্থলীতে রক্তক্ষরণ  হয়েছে সেই রক্ত নাড়িভুঁড়ি দিয়ে আস্তে আস্তে জমাট বাঁধে জমে পায়খানার সাথে বেরিয়ে যায় তখন পায়খানার রং হয় আলকাতরার মত কালো। এমন লক্ষণ দেখা দিলে বসে না থেকে দ্রুত হাসপাতালে যেতে হবে  এবং পরীক্ষা করে দেখতে হবে।

 কুশন গুলো ফুলে পায়ুপথ দিয়ে বের হয়ে আসতে পারে।

এগুলো নরম গোটার মতো মনে হয় সাধারণত মলত্যাগের পরে এগুলো বের হয়ে আসে আবার নিজে নিজেই  ভিতরে ঢুকে যায় বা আঙ্গুল দিয়ে ভিতরে ঢুকাতে হতে পারে, আবার কারো কারো ক্ষেত্রে পায়েলস এমন অবস্থায় পৌঁছে যায় যে আংগুল দিয়ে ওর ভেতরে ঢুকিয়ে দেওয়া যায় না।

অনেকেই দুশ্চিন্তা করেন যে এই রোগের ব্যথা কেমন হয়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই রোগের কোন ব্যথা   তীব্র ব্যথা হয় না,, তবে কখনো  কখনো তীব্র ব্যথা হতে পারে, যেমন পায়ুপথ থেকে বের হয়ে আসা কুশন গুলো বেশি বড় হলে আঙ্গুল দিয়ে ওর ভিতরে ঢুকানো যায় না, সেক্ষেত্রে পায়ুপথের মুখ বন্ধ হয়ে যায়, রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়, এবং অনেক ব্যথা সৃষ্টি হয়। সাধারণত এক থেকে দুই দিনের জন্য হয়।

এমন তীব্র ব্যথা দিলে দ্রুত ডাক্তারের কাছে যাবেন, যদি তৎক্ষণাৎ ডাক্তারের কাছে যাওয়া সম্ভব না হয়  সে ক্ষেত্রে কিভাবে প্রাথমিক চিকিৎসা নেবেন একটু পরেই সেই বিষয়ে আলোচনা করছি।

ডাক্তারের পরামর্শমতো ওষুধ খাওয়ার পাশাপাশি এ কাজগুলো করতে পারবেন।

পাইলস হলে পায়ুপথ চুলকাতে পারে, পায়ুপথ দিয়ে পিচ্ছিল কিছু পদার্থ বের হতে পারে, মনে হতে পারে এখনো  পেট পরিষ্কার হয়নি আবারো মলত্যাগ করতে হতে পারে।

পাইলস এর চিকিৎসা

পাইলসের চিকিৎসায় একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করা। এর জন্য একটা ভালো ঔষধ হচ্ছে ইসবগুলের ভুষি, আমরা সবাই কম বেশি চিনি, তবে এর সাবধানতা এবং সঠিক ব্যবহার অনেকের অজানা। ইসবগুলের ভুষি কখন খাবেন? কিভাবে খাবেন? কখন খাওয়া উচিত না, অল্প করে বলে দিচ্ছি।

প্যাকেটের গায়ে লিখা পরিমান মত পানি নিয়ে তাতে ইসবগুলের ভুষি ভালোভাবে গুলিয়ে  নেবেন যাতে সরবতি দেখতে পরিষ্কার বা হালকা ঘোলা দেখায়। বানানোর পর রেখে দিবেন না সাথে সাথে খেয়ে নেবেন। অনেকেই সর্বাধিক গুলিয়ে অনেকক্ষণ রেখে দেয় কিন্তু এটা সঠিক ব্যবহার নয়। সাধারণত দিনে দুইবার ইসুবগুলের ভুসি খেতে হয়, খাবার খাওয়ার পর খেলে সবচেয়ে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। মনে রাখবেন ইসবগুলের ভুষি খেলে অন্তত দিনে দুই লিটার করে পানি পান করবেন।

অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায় ইসুবগুলের ভুষি খেয়ে পর্যাপ্ত পানি পান না করার কারণে গলনালী এবং অন্ত্রের মুখ বন্ধ হয়ে গেছে, আপনি অবশ্যই যাবেন না এমনটি আপনার সাথে হোক।

কোন কোন সময় এই ইসুবগুলের ভুষি খাওয়া যাবেনা, সেগুলো কি কি?

  •  রাতে ঘুমানোর ঠিক আগে খাবেন না, তাতে আপনার বৃহদন্ত্র অর্থাৎ যেখানে মাল তৈরি হয় সে জায়গার মুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
  •  যদি পেটে ব্যথা বমি বমি ভাব হয়।
  •   ইসুবগুলের ভুষি খাওয়ার পরে যদি আপনার শরীরে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়ে থাকে।
  •  যদি দীর্ঘদিন মলত্যাগ না হওয়ার ফলে মলদ্বারের মুখ আটকে গেছে সে ক্ষেত্রে ইসবগুলের ভুষি খাবেন না।
  •  যদি আপনার পায়খানা বা মলত্যাগের অভ্যাস সে হঠাৎ পরিবর্তন হয়, এবং সেটা দুই সপ্তাহের বেশি থাকে।
  •  যদি আপনার পায়ুপথ থেকে আগে থেকেই রক্ত যায় এবং কেন যায় এটার কারণ আপনি সঠিকভাবে জানেন না।
  •  যাদের বৃহদন্ত্রের মাংস  পেশী দুর্বল বা ধীর গতির।
  •  ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া দীর্ঘদিন একা একা ইসবগুলের ভুষি খাবেন না কারণ এটা কিন্তু একটা ওষুধ ডায়রিয়াসহ এর আরো কিছু প্রতিক্রিয়া হতে পারে। তিন   দিন পার হওয়ার পরে  কোষ্ঠকাঠিন্য কোন  উন্নতি না হলে ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন।

পাইলস এর ঔষধের নাম

ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল খেতে পারেন, আরো অনেক ধরনের  ঔষধ আর মলম আছে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী তা গ্রহণ করতে পারেন,, তবে পাইলস হলে কিছু কিছু ব্যথানাশক ওষুধ খাওয়া যাবে না,, সেগুলো কি কি?

 ট্রামাডল, কারণ এই  ঔষধ একটা কমন প্রতিক্রিয়া হচ্ছে কোষ্ঠকাঠিন্য, বাজারে প্যারাসিটামল  এর সাথে ট্রামাডল  মিশানো ব্যথানাশক ঔষধ পরিহার করুন। 

 হাইব্রোপ্রোফ্যান, কারণ এই ওষুধটা রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।

ঘরে বসে ঔষধের পাশাপাশি আরো কিভাবে নিজের চিকিৎসা করতে পারবেন, ব্যথা কমাতে পারবেন।

  • ব্যথার জায়গাটা কুসুম গরম পানিতে ভিজিয়ে রাখতে পারেন, ছোট বাচ্চাদের গোসল করার ছোট্ট একটি  বল কুসুম গরম পানিতে হালকা লবন মিশিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকতে পারেন। এই চিকিৎসা দিনে তিনবার নিতে পারেন।
  • সদ্য যারা মা হয়েছেন তাদের বাচ্চা হওয়ার পর প্রথম কিছুদিন এই পাইলসের সমস্যা বেড়ে যেতে পারে তাদের ক্ষেত্রেও কুসুম গরম পানির সেঁক দিতে বলা হয়। আর মায়েদের  ক্ষেত্রে  কোথায়  বসতেগেলে একটি নরম বালিশ ব্যবহার করতে পারেন।
  • একটা নরম কাপড়ে পেঁচিয়ে পায়ুপথে লাগাতে পারেন।
  • বিছানায় শুয়ে শুয়ে উঁচু করে রাখতে পারেন তাহলে গোটা গুলোতে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক থাকবে। পায়ের নিচে বালিশ দিতে পারেন, খাটের পা একটু উঁচু করে দিতে পারেন।
  • পায়ুপথ সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং শুকনো রাখতে হবে, মলত্যাগ করার পর খুব জোর দিয়ে যাবেন না, দরকার হলে টয়লেট পেপার হালকা ভিজিয়ে তারপর সেটা দিয়ে মুছতে পারেন।
  • খুব জোরে চাপ দিয়ে মলত্যাগ করবেন না।
  • লম্বা সময় ধরে মলত্যাগ করা যাবে না, টয়লেটে বসে পেপার পড়া মোবাইল  চালানো এগুলো একেবারেই করা যাবে না, অন্য কোন দিকে মনোনিবেশ করবেন না।
  • পায়খানার চাপ আসলে আটকে রাখবেন না, পায়খানা আটকে রাখলে দিনদিন সেটা থেকে পানির আর্দ্রতা কমে যায় এবং শক্ত হতে থাকে, তাই দেরি না করে বাথরুমে চলে যাবেন।
  • কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে বাঁচতে খাবারে যথেষ্ট পরিমাণে ফাইবার বা আঁশ নিশ্চিত করবেন, এবং প্রচুর পরিমাণে পানি পান করবেন। এই দুটো কাজ করলে সাধারণত কয়েক দিনের মধ্যে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয় এবং কয়েক সপ্তাহের মধ্যে লক্ষণগুলো উপশম হয়,  দেড় মাস অথবা ছয় সপ্তাহ যদি খাবারের ভিতরে ফাইবারের সংখ্যা নিশ্চিত করা যায় তাহলে 95% পাইলস রোগীর পায়খানার সাথে রক্ত যাওয়া কমে আসে।
  • নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম করবেন, ভাবি ব্যায়াম, বা প্রতিদিন দৌড়াতে হবে এমন না শরীরকে চলমান রাখতে হবে। সেটা হাঁটাচলা হালকা যোগব্যায়াম ইত্যাদি হতে পারে। দিনে অন্তত 20 মিনিট   হাঁটার অভ্যাস করুন অল্প অল্প দিয়ে শুরু করেন। গবেষণায় দেখা গেছে এতোটুকু হাঁটলেও সেটা কোষ্ঠকাঠিন্যের জন্য উপকারী।
  • ওজন অতিরিক্ত হলে সেটা কমিয়ে ফেলুন।

 কখন ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবেঃ

  •  যদি সাত দিন বাড়িতে চিকিৎসা করেও পাইলসের কোন উন্নতি না হয়।
  •  যদি  বারবার পাইলস হতে থাকে।
  •  বয়স যদি পঞ্চাশের বেশি হয় এবং প্রথমবারের মতো  পাইলস দেখা দেয়।

 কখন হাসপাতালে যাবেনঃ

  •  যদি পাইলস থেকে পুঁজ বের হতে থাকে।
  •  যদি গায়ে জ্বর আসে কাঁপুনি হয় এবং খুব অস্বস্তি লাগতে থাকে।
  •  যদি অনবরত রক্তক্ষরণ হতে থাকে।
  •  যদি অনেক বেশি রক্ত যেতে থাকে কম্পানি লাল হয়ে গেছে ,বড় বড় রক্তের টাকা পড়ছে।
  •  যদি খুব ব্যথা হয়।
  •  যদি পায়খানা আলকাতরার মত কালো হয়।

শেষ কথাঃ

আজ আমরা জানলাম, পাইলস এর ঘরোয়া চিকিৎসা মলদ্বারের যেকোনো অসুখ-ই যে পাইলস তা নয়। মলদ্বারের যেকোনো সমস্যায় অবহেলা না করে, দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন,, সুস্থ থাকুন,, আপনার সুস্থতাই আমাদের একান্ত কাম্য। আমাদের পাশে থাকার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

আরও পড়ুন-

সুস্থ থাকার জন্য খাবারের তালিকা

আমাশয় রোগের ঘরোয়া চিকিৎসা

Leave a Comment