মধু খাওয়ার উপকারিতা, পুষ্টিগুণ ও খাওয়ার নিয়ম

মধু খাওয়ার উপকারিতা

প্রতিদিন আমরা অনেকেই নানাভাবে মধু খেয়ে থাকি কিন্তু এর উপকারিতা সম্পর্কে আমাদের ধারণা অনেকটাই কম। মধু খাওয়ার উপকারিতা অনেক। মধু আমাদের শরীরে নানারকম পুষ্টি যুগিয়ে থাকে।

এটি একটি প্রাকৃতিক আন্টিব্যায়োটিক। যা আমাদের শরীরে শক্তি যোগিয়ে থাকে, রোগ-প্রতিরোগক্ষমতা বাড়িয়ে থাকে, চোখের স্বাস্থ্য উন্নত করে এবং মস্তিষ্কেরও কাজকর্ম ভালো রাখে। মধুতে রয়েছে  প্রাকৃতিক গ্লুকোজ ও ফ্রুক্টোজ, যা আমাদের শরীরে শক্তি বৃদ্ধি করে থাকে।

গ্লুকোজ এবং ফ্রুক্টোজের পাশাপাশি মধুতে রয়েছে নানারকমের ভিটামিন, খনিজ লবণ, অ্যামিনো এসিডসহ আরো ৪৫ টি পুষ্টি উপাদান রয়েছে। মধু আমাদের জন্য সৃষ্টিকর্তার এক অন্যতম নিয়াতম।

মধু খাওয়ার উপকারিতার মধ্যে শরীরের হজমশক্তি বৃদ্ধি, কোষ্ঠকাঠিন্যতা দূরীকরণ, সর্দি-কাশির প্রকোপ কমা, ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণ, শরীরের ওজন কমানো অন্যতম এবং এসবের পাশাপাশি মধু ত্বকের জন্যও অনেক উপকারী।

তবে এই মধু খাওয়ার যেমন অনেক উপকারিতা রয়েছে ঠিক তেমনি মধু খাওয়ার অনেক নিয়মও রয়েছে। একেক নিয়মে মধু খেলে একেকরকম উপকার পাওয়া যায়।আজকে মধু খাওয়ার উপকারিতার পাশাপাশি মধু কিভাবে এবং কোন সময় খেলে উপকার হবে সব জানব। তবে তার আগে জেনে নিই মধুর পুষ্টি উপাদান সমন্ধে।

মধু খাওয়ার উপকারিতা – পুষ্টি উপাদান

মধু খাওয়ার উপকারিতা

আমরা ইতিমধ্যেই জেনেছি যে, খাঁটি মধুতে ৪৫ টি পুষ্টি উপাদান রয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে ২৫ থেকে ৩৭ শতাংশ গ্লুকোজ, প্রায় ১১ শতাংশ বিভিন্ন প্রাকৃতিক এনজাইম, ০.৫ থেকে ৩.০ শতাংশ সুক্রোজ,  ৫ থেকে ১২ শতাংশ মল্টোজ, ৩৪ থেকে ৪৩ শতাংশ ফ্রুক্টোজ,প্রায় ২৮ শতাংশ খনিজ লবণ, প্রায় ২২ শতাংশ অ্যামাইনো এসিড।

তাছাড়া  খাঁটি মধু চর্বি ও প্রোটিনমুক্ত এবং একশ গ্রাম মধুতে ২৮৮ ক্যালরি রয়েছে।

মধু খাওয়ার উপকারিতা

আপনি যদি সুস্থ থাকতে চান তাহলে আপনাকে অবশ্যই নিয়মিত মধু খেতে হবে। আপনি যদি নিয়মিত মধু খান তাহলে আপনার সুস্থ থাকার নিশ্চয়তা অনেকটাই বেড়ে যায়। কারণ, মধুতে থাকা পুষ্টি উপাদান আপনার শরীরকে সক্ষম রাখে।মধুর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকারিতা হল আমাদের যখন ঠান্ডা লাগে অথবা গলা ব্যথা হয় আমরা তখন কুসুম গরম পানিতে মধু মিশিয়ে খায় অথবা শুধু মধুটাই সেবন করে থাকে।

কেননা, মধু আমাদের শরীরের তাপ বৃদ্ধি করে শরীরকে গরম রাখে। এতে থাকা প্রাকৃতিক অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট আমাদের ঠান্ডাজনিত সমস্যা,সর্দিকাশি প্রতিরোধ করে থাকে। মধু খাওয়ার এমন আরো অনেক উপকারিতা রয়েছে যা নিচে দেওয়া হলঃ

  • মধুতে রয়েছে প্রাকৃতিক অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট যা মানুষের দেহের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে থাকে। 
  • নিয়মিত মধু খেলে হজমশক্তি বৃদ্ধি পায়। 
  • রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ বাড়িয়ে মধু শরীরের রক্তশূণ্যতা দূর করে থাকে। 
  • মধু খেলে আমাদের শরীরে শক্তির সঞ্চার হয়। যদি শারিরীকভাবে দুর্বল হয়ে থাকেন তবে নিয়মিত মধু সেবন করলে আপনি শারিরীকভাবে শক্তি অনুভব করবেন। 
  • মধু বাতের ব্যথা কমাতেও যথেষ্ট সাহায্য করে। 
  • আপনি যদি কোষ্ঠকাঠিন্যতায় ভুগে থাকেন তবে মধু আপনার জন্য বেশ উপকারি। প্রতিদিন মধু খেলে আপনার কোষ্ঠকাঠিন্যতার সমস্যা দূর হয়ে যাবে। 
  • যারা অনিদ্রায় ভুগছেন তারা প্রতিদিন রাতে একগ্লাস দুধের সাথে মধু মিশিয়ে খেলে ভালো ঘুম হবে। 
  • মধু ফুসফুসের জন্য অনেক উপকারি। 
  • যৌন দূর্বলতা দূরীকরণে মধু বিশেষ ভূমিকা পালন করে। 
  • মধু আমাদের দেহের কপার, লৌহ, ম্যাঙ্গানিজ ইত্যাদি খনিজ উপাদানের ঘাটতি পূরণ করে থাকে। 
  • মধু আমাদের মুখের ভিতরের নানাধরণের ঘায়ের সমস্যা দূর করে থাকে। নিয়মিত মধু খেলে দাঁতও মজবুত হয়ে থাকে। 
  • মধু খেয়ে আমাদের ওজন নিয়ন্ত্রণ করে, কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রনে থাকে, ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণে থাকে। 
  • ডায়রিয়া হলে এক লিটার পানিতে ৫০ মিলিমিটার মধু মিশিয়ে খেলে শরীরের পানিশূন্যতার ঘাটতি হয় না। 
  • মধু আমাদের ত্বকের জন্য উপকারি। এটি আমাদের ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে, ব্রণের সমস্যা থেকে মুক্তি দান করে। 
  • মধু ব্যবহারে চুলও অনেক সুন্দর হয়। 

মধু খাওয়ার উপকারিতা – শিশুদের জন্য

শিশুদের জন্যও মধু অনেক উপকারি। শিশুদের মধু খাওয়ালে তা তাদের হাড়কে মজবুত করে, তাদের  দৃষ্টিশক্তি এবং স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। তাই শিশুদের মধু খাওয়ানো বেশ জরুরি। কিন্তু শিশুদের বয়সভেদে মধুর পরিমাণও কমবেশি হবে তাই পরিমান নিশ্চিত হয়ে আপনার শিশুকে নিয়মিত মধু খাওয়ান। 

তবে একবছর বয়সের পর থেকে শিশুকে ৩-৪ ফোঁটা মধু খাওয়ানো যায় যা শিশুর মানুষিক ও শারীরিক বিকাশের জন্য খুবই উপকারী। মধু খাওয়ার উপকারিতা তো জানলাম কিন্তু মধু কিভাবে খেতে হবে সেটিই এখন জানার বিষয়। 

মধু খাওয়ার নিয়ম

যদিও মধু খাওয়ার বিশেষ কোন নিয়ম নেই কিন্তু এর উপকারিতাভেদে মধু খাওয়ার বিশেষ কিছু নিয়ম রয়েছে।

  • শরীরকে সুস্থ রাখতে প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ১-২ চামচ মধু খাওয়া উচিত। 
  • আপনার যদি সর্দি, কাশি ও স্বরভেঙ্গে যায় তাহলে এক চামচ মধুর সাথে আদার রস মিশিয়ে খেলে উপকার যায়। তাছাড়াও, এক চামচ তুলসী পাতার রসের সাথে এক চামচ মধু মিশিয়ে খেলে সর্দি, কাশি থেকে পরিত্রান পাওয়া যায়। 
  • আমাশয় বা ডায়রিয়া সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে হলে গরম পানিতে আড়াই চামচ মধু মিশিয়ে বারবার খাওয়া উচিত। 
  • আপনি যদি শরীরের মেদ কমাতে চান তাহলে সকালে ঘুম থেকে উঠে খালি পেটে কুসুম গরম পানির সাথে ১-২ চামচ মধু এবং তার সাথে লেবু মিশিয়ে সেবন করুন। 
  • শারীরিক দুর্বলতা কমাতে কাঁচা ছোলা ভিজিয়ে রেখে তাতে মধু মিশিয়ে খাওয়া উত্তম।
  • চিনির বদলে চা, কফি এবং মিষ্টিজাতীয় খাবারে মধু মিশিয়ে খেতে পারেন। 
  • বলা হয়, কালোজিরা মৃত্যু ছাড়া সকল রোগের ঔষধ। আপনি যদি প্রতিদিন কালোজিরার সাথে একচামচ মধু মিশিয়ে খান, সেটি আপনার শরীরের অনেক জটিল রোগের সমাধান করবে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,যে ব্যক্তি মাসে তিন দিন সকাল বেলা মধু চেটে সেবন করবে, ওই মাসে তার কোন কঠিন রোগব্যাধি হবে না। 
  •  কোষ্ঠকাঠিন্যতা থেকে রেহাই পেতে এক গ্লাস পানিতে ২ চামচ ইসুফগুলের ভুসির সাথে এক চামচ মধু মিশিয়ে খালি পেটে পান করুন। 
  • মধুর সাথে দারুচিনির গুড়ো মিশিয়ে খেলে কিছুদিন খেলে রক্তনালীর সমস্যা থেকে সমাধান পাওয়া যায়।

মধু খাওয়ার সঠিক সময়

সঠিক সময়ে মধু খেলে মধু খাওয়ার উপকারিতা অনেক বেশি পাওয়া যায়। সাধারণত মধু সকালে ঘুম ঠেকে উঠে খালি পেটে খাওয়া সবচেয়ে উত্তম। মধু সকালে খালি পেটে খেলে এটি অনেকটা ঔষধের মত কাজ করে, এমনকি মধু ৯৯ রোগের মহাঔষধ।

তাছাড়া খালি পেটে মধু খেলে সকল পুষ্টি উপাদান খুব ভালোভাবে আমাদের শরীরে কাজ করে। তবে আপনি যদি দুধের সাথে মিশিয়ে মধু খান তখন আপনি চাইলে সকালে বা রাতে যেকোন সময় খেতে পারবেন। 

মধু কাদের খাওয়া উচিত না

যদিও মধু খাওয়ার উপকারিতা অপরিসীম। কিন্ত মানুষের শারীরিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে এর কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও রয়েছে। যেমনঃ আপনার যদি ডায়বেটিসের সমস্যা থেকে থাকে তাহলে আপনার জন্য মধু খাওয়া একদমই অনুচিত। তবে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী আপনি মধু খেতে পারেন।

আবার, আপনি যদি ওজন কমাতে চান তাহলে মধু অনেক বেশি খাবেন না। কারন, মধুতে থাকা ক্যালরি আপনার ওজন বাড়িয়ে দিবে।মধু যেমন উচ্চরক্তচাপের জন্য ভালো তেমনই যাদের নিম্ন রক্তচাপ তারা অধিক পরিমানে মধু খাবেন না। কেননা, মধুতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে।

অনেকেই আছেন যাদের বিভিন্ন উপাদানে  অ্যালার্জি আছে তারা অবশ্যই মধু খাওয়ার আগে ডাক্তারের সাথে কথা বলে নিবেন অথবা মধুর উপাদানগুলো যাচাই করে নিবেন। 

শেষ কথা

মধু খাওয়ার উপকারিতার কথা বলে শেষ করা যাবে না। এর এমন হাজারো উপকারিতা রয়েছে যা আপনাকে সুস্বাস্থ্য দিতে সাহায্য করে। বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)- এর মতে সকল পানীয় উপাদানের মধ্যে মধু সর্বোৎকৃষ্ঠ। তিনি বলেন- মধু  এবং কোরআনের মাধ্যমে তোমাদের চিকিৎসা নেয়া উচিত। -(সুনানে ইবনে মাজাহ, হাকেম)।

তিনি আরোও বলেন, যে ব্যক্তি প্রত্যেক মাসে তিন দিন ভোরে মধু চেটে খায় তার কোন বড় বিপদ হতে পারে না।” -(ইবনে মাজাহ, বয়হাকী)। শুধু তাই নয় আপনি যদি নিয়মিত মধু আপনার চুলে ও ত্বকে ব্যবহার করেন তবে আপনার চুল ও ত্বক হবে প্রাণবন্ত। তবে আপনাকে অবশ্যই  খাঁটি মধু গ্রহন করতে হবে। 

মধু খাওয়ার উপকারিতা সম্পর্কিত প্রশ্ন ও উত্তর / FAQ

১।খাঁটি মধু চেনার উপায় কি?

উত্তরঃ খাঁটি মধু ফ্রিজে রাখা দিলে এটি স্ফটিকাকার হবে না, বরং মধু তরল অবস্থাতেই থাকবে। আর যেসব মধুতে ভেজাল  আছে তা ফ্রিজে রেখে দিলে শক্ত এবং স্ফটিক হয়ে যায়। এছাড়াও ভেজাল মধুর উপরিভাগে চিনির একটি সাদা স্তর আলাদা হয়ে থাকতে দেখা যায়।আবার, ভিনেগার-পানির দ্রবণে কয়েক ফোঁটা মধু মেশালে যদি ফেনা তৈরি হয় তবে মধুটি খাঁটি নয়।

২। মধু কি ঠান্ডা দুধে মিশিয়ে খাওয়া যাবে? 

উত্তরঃ মধু ঠান্ডা দুধ অথবা পানিতে না মিশিয়েই খাওয়া ভালো বরং কুসুম গরম দুধ ও পানিতে দিয়ে খাওয়া যেতে পারে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে মধু কখনই ফুটন্ত গরম দুধ ও পানিতে মিশিয়ে খাওয়া উচিত না। 

৩। রান্নায় মধু ব্যবহার করা যাবে কি? 

উত্তরঃ রান্নায় সরাসরি মধু ব্যাবহার করা উচিত না। রান্না শেষে খাবারে মধু মিশিয়ে খাওয়া যেতে পারে।

৪।গর্ভবতী নারী কি মধু খেতে পারবেন?

উত্তরঃ অবশ্যই, গর্ভবতী নারীদের খাওয়া একদম নিরাপদ। 

আরও পড়ুন-

লবঙ্গের উপকারিতা ও অপকারিতা, লবঙ্গ খাওয়ার নিয়ম

ঘি এর উপকারিতা, ঘি খাওয়ার নিয়ম ও পুষ্টিগুণ

Leave a Comment