মিশরের পিরামিড অজানা তথ্য

মিশরের পিরামিড

আরবিতে একটি প্রবাদ রয়েছে যে, মানুষ ভয়পায় সময়কে আর সময় ভয়পায় পিরামিডকে। মিশরের পিরামিড এর নাম সুনলেই আমাদের মনে জাগে হাজারও প্রশ্ন। আধুনিক প্রযুক্তি উদ্ভাবনের বহুআগে কিভাবে নির্মান করা হয়েছিলো এসব বিশাল, আশ্চর্য ও রহস্যময় স্থাপনা?

কিভাবে বয়ে আনা হয়েছিল এই বিশাল আক্রিতির পাথর খন্ডগুলো?  যার এক একটির ওজন ছিল প্রায় ৬০ টন, আর দৈর্ঘ্য ছিল ৩০ থেকে ৪০ ফুটের মত। কিভাবে কাটা হয়েছিলো এবং টেনে তোলা হয়েছিলো এতটা উচ্চতায় ? আর কেনই বা তৈরি করা হয়েছিলো এসব পিরামিড? নীলনদের তীরে অবস্থিত প্রায় ৫০০০ হাজার বছরের

পুরোনো মিশরের পিরামিডের এসব অমিমাংশিত বিষয় নিয়েই সাজানো হয়েছে আমাদের আজকের এই  আর্টিকেল। চলুন তা হলে দেরি না করে যেনে নেয়া যাক বিস্তারিত সকল তথ্য।

মিশরে কতটি পিরামিড রয়েছে

মনে করা হয় যে, মিশরে ছোট বড় সব মিলে প্রায়  ১১৮ থেকে ১৩৮ টি পিরামিড রয়েছে,  যার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত এবং সুপরিচিত পিরামিডগুলি হল গিজার পিরামিড। 

এগুলোর মধ্যে অন্যতম মিশরের পিরামিড গুলো হলো:

১. গিজার গ্রেট পিরামিড যা খুফুর পিরামিড নামেও পরিচিত।

২. খাফ্রের পিরামিড এবং,

৩. মেনকাউরের পিরামিড। 

এছাড়াও গিজার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য পিরামিডের মধ্যে রয়েছে সাক্কারার জোসারের স্টেপ পিরামিড, দাহশুরের বেন্ট পিরামিড এবং দাহশুরের লাল পিরামিড ইত্যাদি।

পিরামিডের কথা আসলেই মূলত বারবার গিজার পিরামিড গুলোই আলোচনায় আসে। গিজার পিরামিট গুলো ছাড়াও ইথিওপিয়া,ইরিত্রিয়া,সুদান, লাতিন আমেরিকার পেরুতেও পিরামিড দেখতে পাওয়া যায়। পিরামিডের দেশ মিশরকে বলা হলেও সবচেয়ে বেশি পিরামিডের দেশ কিন্তু মিশর নয়। সর্বাধিক পিরামিড যে দেশটিতে রয়েছে তার নাম সুদান।

আরও পড়ুনঃ খেজুরের উপকারিতা এবং অপকারিতা

মিশরে পিরামিডের সংখ্যা যেখানে ১৩৮ টি, সেখানে সুদানে পিরামিডের সংখ্যা ২৫৫ টি। সুদানের পিরামিডগুলো তৈরি হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব এক হাজার ৭০ থেকে ৩৫০ অব্দে, কুশ নামের রাজাদের শাসনামলে। তবে এগুলো তৈরি হয়েছে মিশরে পিরামিড তৈরি হওয়ার ৫০০ বছর পরে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পিরামিড টি হচ্ছে মিশরের গিজায় অবস্থিত, গিজার গ্রেট পিরামিড,  যা খুফুর পিরামিড নামেও পরিচিত।

মিশরের পিরামিড কেন তৈরি করা হয়েছিলো  

প্রাচীন মিশরীয়রা আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়াই কীভাবে এত বড় বড় কাঠামো তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল। এবং তাদের আসল উদ্দেশ্যই বা কী ছিলো সে সম্পর্কে তথ্যগুলি আজো পরিস্কার না। তবে গবেষক, ইতিহাসবীদদের ধারনা এবং ইতিহাস থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ধারনা করা হয় যে, কোন একক কারনে এসব পিরামিড তৈরি হয়নি, এসব পিরামিড তৈরীর পিছনে ছিলো বেশ কিছু কারন। 

মিশরের পিরামিড

তার মধ্যে অন্যতম কিছু কারন হচ্ছে: 

প্রাচীন মিশরীয়রা বিশ্বাস করতো যে, মৃত্যুর পরেও মানুষের আর একটি জীবন রয়েছে। আর সেটাই অনন্ত জীবন। তাই মৃত্যুর পর দেহকে অক্ষত অবস্থায় সংরক্ষন করতে এবং পরোলোকে অনন্ত শান্তির জীবন পেতে ফারাও তথা ততকালীন রাজাদের সমাধিস্থ করা হতো আর সেই সমাধিস্থলে নির্মিত হত পিরামিড।

প্রাচীন মিশরে কেবলমাত্র ফ্যারাও এবং ধনী অভিজাত শ্রেণির লোকদেরই মৃত্যুর পর মৃতদেহকে মমি করে সংরক্ষণ করার অধিকার ছিল। ধনী পুরোহিত শ্রেণির তত্ত্বাবধানে তৈরি হত এসব মমি ও পিরামিডগুলি।কতিপয় বিজ্ঞানি তত্ত দেন যে, প্রাচীন মিশরের ফারাও এবং‌ অভিজাতগণ পিরামিড তৈরির মধ্যে দিয়ে নিজেদের সমাধি  নির্মাণ করে মৃত্যুর পরেও তাদের স্মৃতিকে অমর করে রাখতে চেয়েছিলেন।

আবার এটিও ধারনা করা হয় যে, প্রাচীন মিশরের অধিবাসীরা ছিল রক্ষণশীল মনোভাবাপন্ন। তারা মনে করত যে, মানুষের দেহ থেকে শুরু করে সব কিছুই প্রকৃতির দান, যা কখনোই নষ্ট করা উচিত নয়। এই মনোভাব থেকেই তারা মৃতদেহকে রক্ষার জন্য মমি বানাত। প্রথমদিকে তারা এই মমিকে সাধারণভাবেই সমাধিত করত। মাটির নীচে শায়িত মমির পাশে তারা বহু ধনরত্ন এবং তার ব্যবহার্য জিনিসপত্র রাখত।

আরও পড়ুনঃ পাইলস এর প্রাথমিক চিকিৎসা

কিন্তু অচিরেই সেগুলি লুঠ হয়ে যেত। তাই মমির সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তা থেকেই তৈরি করা হতো পিরামিড। এটিও ধারনা করা হয় যে, মিশরের ফ্যারাওগণ পিরামিড তৈরির মধ্যে দিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে নিজেদের মহিমা প্রচার করতে চেয়েছিলেন। মেনেস, খুফু, তুতেনখামেন, দ্বিতীয় রামেসিস, নেফরা- সহ বিভিন্ন ফ্যারাও এই লক্ষ্য নিয়েই বড়ো বড়ো পিরামিড তৈরি করে গেছেন বলে অনেকে ধারনা করেন।

পিরামিড কিভাবে তৈরি করা হয়েছিলো

যেই বিশাল আকারের পাথর খন্ডগুলো ব্যবহার করে পিরামিড তৈরি করা হয়েছিলো সেগুলো বয়ে আনা হয়েছিলো অনেক দূর দূরান্ত থেকে। প্রাচীন মিশরীয়রা কীভাবে এই বিশাল পাথরগুলিকে স্থানান্তর করেছিলো এবং একটির উপরে আর একটিকে স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিল এই রহস্যটি ব্যাখ্যা করার অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও অমীমাংসিত রয়ে গেছে।

তবে প্রচলিত মতে এই বিশাল পাথর খন্ডগুলো সংগ্রহ করা হয়েছিল দূর দুরান্তের পাহাড় থেকে। চার হাজার বছরের পুরানো এক সমাধিতে অঙ্কিত এক চিত্রে দেখা যায় যে, চুনাপাথরের বিশাল এক স্তম্ভকে স্লেজে করে সরানো হচ্ছে। অনেক মানুষ রশি দিয়ে সেই স্লেজ টেনে নিচ্ছে। আর তাদের মধ্যে একজন পাত্র থেকে বালির উপরে পানি ঢালছে ।

এতে ঘর্ষণ প্রায় অর্ধেক হয়ে যায়। এভাবে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বড়ো বড়ো সব পাথরের ব্লক গুলোকে। পিরামিডের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া পানি প্রবাহর অস্তিত্ত্ব থেকে অনেকে এটিও ধারনা করেন যে, এগুলো বয়ে আনা হয়েছিলো পানি পথে। আবার অনেকে বিশ্বাস করেন যে পিরামিডগুলো মানুষের তৈরি নয় বরং এগুলি ভীন গ্রহের প্রানী তথা এলিয়েনের তৈরি। এর পিছনেও রয়েছে যুক্তি সঙ্গত কারন।

যে পাথর দিয়ে পিরামিড তৈরি করা হয়েছে তা সাধারণ কোনো পাথর নয়। প্রত্নতত্ত্ববীদ আর গবেষকদের পরীক্ষা অনুসারে পিরামিডে ব্যবহিত পাথর গুলি। যে কোনো চুনাপাথরের চেয়েও শতগুন বেশি শক্তিশালি। 

বিজ্ঞানিদের গবেষনা মতে এগুলি মোটেও কোন সাধারণ পাথর নয়। সারা দুনিয়াতে এ ধরনের পাথর আর কোথাও পাওয়া যায় না। এ জন্যই তারা মনে করেন এই পিরামিডগুলি এলিয়েনের তৈরি, মানুষের নয়। পিরামিডের মধ্যে বাল্বের ছবি কিভাবে আসলো? কিভাবে পৃথিবীর ঠিক মাঝখানে পিরামিটের অবস্থান? কিভাবেই বা এত নিখুদভাবে পিরামিড তৈরি কার হয়েছিলো তা আজো রহস্যময়।

প্রতিনিয়ত এ সকল অজানা তথ্য জানার জন্য প্রত্নতত্ত্ববীদ, গবেষকরা আজও্র নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। হয়ত অদূর ভবিষ্যতে আমারা এসব অজানা তথ্য যানতে পারবো।

আরও পড়ুনঃ টিকটকে ভাইরাল হওয়ার উপায়

মিশরীয় গিজার  পিরামিডের উচ্চতা কত

ধারনা করা হয় যে, এটি তৈরি হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ শতাব্দীর দিকে। এর উচ্চতা প্রায় ৪৮১ ফুট। এটি ৭৫৫ বর্গফুট জমির উপর স্থাপিত যা ৭ টি ফুটবল মাঠের সমান। এটি তৈরি করতে সময় লেগেছিল প্রায় ২০ বছর এবং শ্রমিক খেটেছিল আনুমানিক ১ লক্ষ ও বেশি। এই পিরামিডটি তৈরি করা হয়েছিল বিশাল পাথর খন্ড দিয়ে। যেসব পাথরখণ্ড দিয়ে এটি তৈরি করা হয়েছিল তাদের একেকটির ওজন ছিল ২ থেকে ৬০ টন পর্যন্ত। এটি সমস্ত পিরামিডের মধ্যে বৃহত্তম এবং সবচেয়ে জটিল, এটির নির্মাণে ব্যবহৃত হয়েছে আনুমানিক প্রায় ২৩ লক্ষ  চুনাপাথর খণ্ড বা লাইম স্টন।

মিশরের পিরামিড

পিরামিডের বাইরের আস্তরণ ছিলো উজ্জ্বল চুনাপাথর দিয়ে আবৃত। সূর্যের আলোর প্রতিফলনে মসৃণ, উজ্জ্বল ও চকচকে পিরামিডকে দূর থেকে দেখলেই মনে হতো দৈত্যা আকৃতির কোন এক রত্ন। আশ্চর্জের বিষয় হচ্ছে এটিই কিন্তু ইতিহাসের প্রথম পিরামিট নয়। সাকারায় বানানো ফারাও জোসের (Djoser) পিরামিডকে প্রথম পিরামিড গুলোর একটি হিসেবে ধরা হয়। যেটি তৈরি করা হয়েছিলো বিশ্ব বিখ্যাত গিজার খুফুর পিরামিড তৈরিরও প্রায় একশো বছর আগে।

অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ২৬০০ শতাব্দীর দিকে। সেটা দেখতে কিন্তু ঠিক গিজার পিরামিড গুলোর মত ছিলো না, বরং ছিলো ধাপে ধাপে উপরে উঠে-যাওয়া সিঁড়ির আকৃতির। আর এর ৮২ ফুট গভীরে তৈরি করা হয়েছিলো ফারাও জোসের (Djoser) সমাধি। এর পরে আস্তে আস্তে মিশরীয়রা তৈরি করতে শুরু করে আরো নিখুঁত আকৃতির পিরামিডগুলো যার মধ্যেই রয়েছে গিজার সেই বিখ্যাত তিনটি পিরামিড।

এই পিরামিড গুলোকে পাহারা দেয়ার জন্য গিজায় তৈরি করা হয়েছিল স্ফিংস নামক বিশাল এক দানবীয় মূর্তির। যার মুখ ছিলো মানুষের মত, দেহ সিংহের মতো এবং পাখা ঈগলের মত। গোটা মূর্তিটি মাত্র একটি চুনাপাথর কেটে তৈরি করা হয়েছিল যার দৈর্ঘ্য ছিল ৭৩ মিটার এবং উচ্চতা ছিল ২০ মিটার। 

পৃথিবীতে একটি পাথর কেটে যত ভাস্কর্য তৈরি করা হয়েছে তাদের মধ্যে স্ফিংস সব চেয়ে বড়। মূর্তিটি পূর্বমুখী উদীয়মান সূর্যের দিকে মুখ করে বানানো হয়েছে। দিনের আলোয় স্থাপত্য গুলো যতটা সুন্দর লাগে তার চেয়েও বেশি সুন্দর ও জীবন্ত মনে হয় রাতে। 

কিভাবে যাবেন

মিশরের পিরামিড গিজার শহরটি কায়রো সিটির একটি ছোট শহর এবং কায়রো শহর থেকে এটি প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। তাই আপনি পাতালরেল ধরে কায়রো থেকে মিশরের পিরামিড গিজায় পৌঁছোতে পারেন। এরপর একটা ট্যাক্সিক্যাব নিয়ে চলে যেতে পারেন পিরামিডের কাছে অথবা বাসে করেও যেতে পারেন। এই তিন ভাবে মিশরের পিরামিড গিজার যাওয়া যাই, তবে এটি পুরোটিই আপনার উপর নির্ভর করে, আপনি কিভাবে সেখাবে যাবেন।

আরও পড়ুনঃ গ্রাফিক্স ডিজাইন কি? ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেস কাজ করার নিয়ম

কোথায় থাকবেন

মিশরের পিরামিড দেখতে গিয়ে কোথায় থাকবেন এই নিয়ে অনেকেই চিন্তা করেন। মিশরে অনেক ভালো মানের থাকার খাওয়ার মত হোটেল বা রিসোর্ট রয়েছে। সেগুলি হল- পিরামিডস ইন্ মোটেল এবং পিরামিডস ভিউ বেড আ্যন্ড ব্রেকফাস্ট হলো বাজেট হোটেলগুলোর মধ্যে একটি অন্যতম।

এছাড়াও পিরামিডের নিকটবর্তী মাঝারি মানের হোটেলের মধ্যে বার্সেলো কায়রো পিরামিড, মেয়োর্কা হোটেল ও ক্যানজী হোটেল ইত্যাদি সহ আরও অনেক হোটেল বা রিসোর্ট সেখানে রয়েছে। আর আপনি যদি বিলাসবহুলভাবে সেখানে থাকতে চান, সেক্ষেত্রে তারা হরাইজন্ পিরামিডস হোটেল, লে মেরিডিয়েন্ পিরামিডস হোটেল আ্যান্ড স্পা এবং গ্র্যান্ড পিরামিডস হোটেল বেছে নিতে পারেন।

আমাদের শেষ কথা

প্রিয় পাঠক, আশা করি আমাদের লেখা এই মিশরের পিরামিড সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। আপনি যদি এই সম্পর্কের না জেনে থাকেন তাহলে অবশ্যই ভাল হবে জেনে নিন। কারণ এই বিষয়ে আমাদের সকলেরি যেনে রাখা উচিত। তাই মিশরের পিরামিড সম্পর্কে জানতে সম্পুর্ন পোস্ট মনোযোগ সহকারে পড়ুন। আপনার সুস্থতা কামনা করে আজকের মত এখানেই শেষ করছি। আজ এই পযর্ন্তই, দেখা হচ্ছে পরবর্তি নতুন কোন বিষয় নিয়ে। ধন্যবাদ

আরও পড়ুন-

অনলাইনে ট্রেনের টিকেট কাটার নিয়ম

অনলাইনে বিমানের টিকেট কাটার নিয়ম

Leave a Comment