লবঙ্গের উপকারিতা ও অপকারিতা, লবঙ্গ খাওয়ার নিয়ম

লবঙ্গের উপকারিতা ও অপকারিতা

মূলত ইউজেনল বা Eugenol নামের এক ধরণের যৌগের কারণে লবঙ্গের সুগন্ধি বেড়ে যায়। ফলে তা দেহের বিভিন্ন রোগ সারাতে যেমন কাজে লাগে। ঠিক তেমনই খাবারে স্বাদ বাড়াতেও বহুলাংশে প্রধান কারণ হিসাবে কাজ করে।

সাধারণত এই লবঙ্গ স্বাদে গরম এবং বেশ তীক্ষ্ণ হয়ে থাকে। ধারণা করা হয় লবঙ্গের আবিষ্কার হয় প্রায় ২০০ বছর আগে। সেসময় প্রথমবারের মতো জাভা থেকে চীনের হান-বংশীয় দরবারে দূতরা সম্রাটের কাছে এই মসলা প্রথমবারের মতো পরিবেশন করা হয়।

মধ্যযুগের শেষের দিকে, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে খাবার সংরক্ষণ, খাবারে সুগন্ধ সৃষ্টি করা এবং খাবার সাজানোর ক্ষেত্রেও লবঙ্গ ব্যবহার করা হতো।

পরবর্তী ১৭ শতকের গোড়ার দিকে লবঙ্গের চাষে ধস নামে। কারণ ডাচরা উচ্চ মূল্য বজায় রাখতে চায়। ফলে তারা অ্যাম্বোইনা এবং টারনেট ছাড়া সমস্ত দ্বীপে লবঙ্গ নির্মুল করে ফেলে। আবার ১৮ শতকের শেষার্ধে ফরাসিরা এই লবঙ্গ পাচার করতে থাকে।

বর্তমানে ইন্দোনেশিয়াকে বিশ্বের বৃহত্তম লবঙ্গ উৎপাদনকারী দেশ বলা হয়ে থাকে। ইন্দোনেশিয়ার পর এই লিষ্টে রয়েছে মাদাগাস্কার, তানজানিয়া এবং শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলি। যাইহোক! লবঙ্গের উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে চলুন লবঙ্গ পরিচিতি নিয়ে আলোচনা করা যাক।

লবঙ্গ গাছ মূলত চিরজীবী গাছ। এই গাছ ৪ থেকে ১২ ফুট লম্বা হতে পারে। সাধারণত ছায়াযুক্ত জায়গায় লবঙ্গের চাষ ভালো হয়। এই মসলার চাষ করা হয় সরাসরি বীজ থেকেই। এই গাছ ফল দিতে ৫ বছর সময় পার করে ফেলে। একটি গাছ প্রায় ৩৪ কেজি ফলন দিতে সক্ষম।

গ্রীষ্মের শেষের দিকে এবং শীতকালের মধ্যে লবঙ্গের ফলন ঘরে তোলা হয়। বিভিন্ন রোগ সারাতে এবং খাবারের মান বাড়াতে লবঙ্গ ব্যবহার করা হয়।

আরও পড়ুনঃ রসুন খাওয়ার উপকারিতা

লবঙ্গের উপকারিতা

লবঙ্গের উপকারিতা ও অপকারিতা

লবঙ্গ স্বাদে বেশ মিষ্টি এবং সুগন্ধযুক্ত একটি মশলা। লবঙ্গ গাছের ফুলের কুঁড়ি হলেও এটিতে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি উপকারিতা রয়েছে। চলুন লবঙ্গের উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে লবঙ্গের উপকারিতা নিয়ে বিস্তারিত জানি। 

প্রয়োজনীয় পুষ্টিগুণ 

লবঙ্গের উপকারিতার মাঝে রয়েছে এর বিশাল লিষ্টের পুষ্টিগুণ। এক একটি লবঙ্গে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার, ভিটামিন এবং খনিজ উপাদান থাকে। প্রতি এক চা চামচ বা ২ গ্রাম লবঙ্গে আপনি পাবেন ক্যালোরি ৬ গ্রাম, কার্বোহাইড্রেট ১ গ্রাম, ফাইবার ১ গ্রাম, ম্যাঙ্গানিজ ৫৫ ডিবি, ভিটামিন কে ২% ডিবি।

জানিয়ে রাখা ভালো ম্যাঙ্গানিজ আমাদের মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। তাছাড়া মস্তিষ্কের প্রয়োজনীয এবং শক্তিশালী হাড় তৈরির জন্যও একটি অপরিহার্য খনিজ হিসাবে কাজ করে এই ম্যাঙ্গানিজ। 

অক্সিজেন র‍্যাডিকাল শোষণ ক্ষমতা

লবঙ্গ অক্সিজেন র‍্যাডিকাল শোষণ ক্ষমতার জন্যে বেশ বিখ্যাত। রিসার্চ অনুসারে এটি সর্বোচ্চ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ একটি খাবার। আপনি জেনে অবাক হবেন লবঙ্গে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলি এমন যৌগ যা অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমাতে সাহায্য করে। পাশাপাশি লবঙ্গে লবঙ্গে ইউজেনল নামক একটি যৌগও রয়েছে।

এই যৌগ দেহে প্রাকৃতিক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। তাছাড়া ইউজেনল এমন একটি যৌগ যা শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসাবে ভিটামিন ই এর চেয়েও পাঁচগুণ বেশি কাজ করে। এর মূল কাজ হলো দেহের ফ্রি র‌্যাডিকেল দ্বারা সৃষ্ট অক্সিডেটিভ ক্ষতি রোধ করা। 

ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করে 

গবেষণা থেকে জানা যায় লবঙ্গে পাওয়া যৌগগুলি আমাদের ক্যান্সার থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে। এছাড়াও লবঙ্গে থাকা নির্যাস টিউমারের বৃদ্ধি বন্ধ করতে সাহায্য করে। সবচেয়ে বড় কথা হলো যেকোনো ক্যান্সার কোষকে মেরে ফেলতেও লবঙ্গ বেশ কার্যকর ভুমিকা পালন করে। রিসার্চ অনুসারে খাদ্যনালীর ক্যান্সার কোষের ৮০ কোষের মৃত্যু ঘটায় এই লবঙ্গ। 

ব্যাকটেরিয়া মেরে ফেলে 

লবঙ্গের উপকারিতা ও অপকারিতার মাঝে বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি উপকারিতা হলো লবঙ্গ ব্যাকটেরিয়া মেরে ফেলতে সাহায্য করে। লবঙ্গের অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল বৈশিষ্ট্যের কারণেই মূলত এমনটা হয়ে থাকে। তিনটি সাধারণ ধরণের ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলতে পারে এই মসলা।

আর যদি এসব ব্যাকটেরিয়ার মৃত্যু না ঘটে সেক্ষেত্রে তা খাদ্যে বিষক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়াও লবঙ্গে থাকা অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্য আমাদের মৌখিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতে সহায়তা করে। যার কারণে প্রায়শই ভেষজ মাউথওয়াশের উপাদান হিসাবে লবঙ্গকে ব্যবহার করা হয়। ব্যাকটেরিয়া দূর করার পাশাপাশি লবঙ্গ মাড়ির রোগ সারাতেও সহায়তা করে থাকে। 

লিভারের স্বাস্থ্য ভালো রাখে 

গবেষণায় দেখা গেছে যে লবঙ্গে বেশ কিছু উপকারী যৌগ রয়েছে। এসব যৌগগুলি লিভারের স্বাস্থ্যের উন্নতিতে সাহায্য করে থাকে। বিশেষ করে যৌগ ইউজেনল লিভারের কার্যকারিতা উন্নত করতে সাহায্য করে। এই যৌগ অক্সিডেটিভ স্ট্রেস হ্রাস করে লিভারকে সুস্থ রাখে।

পাশাপাশি লিভারের জ্বালাপোড়া দূর করতেও কাজ করে এই বিশেষ যৌগটি। তাছাড়া ইউজেনল লিভার সিরোসিস রোগ সারাতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। লবঙ্গের উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে ভালভাবে জানা দরকার।

ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণ করে 

রক্তে শর্করাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে এই লবঙ্গ। যার ডায়াবেটিস রোগীদের সুস্থতা নিশ্চিত করে বিশেষভাবে প্রয়োজন পড়ে।  লবঙ্গ এবং নাইজেরিসিন রক্ত থেকে কোষে চিনির গ্রহণ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। সেই সাথে লবঙ্গ আমাদের দেহের ইনসুলিনের নিঃসরণ বাড়ায়। সেই সাথে ইনসুলিন তৈরি করে এমন কোষগুলির কার্যকারিতা উন্নত করতেও সাহায্য করে।

হাড়ের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখে 

হাড়ের সমস্যা সাধারণত বয়স্ক প্রাপ্তবয়স্কদের প্রভাবিত করে থাকে। আর এই সমস্যা পরবর্তীতে অস্টিওপরোসিস সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। অন্যদিকে লবঙ্গ ম্যাঙ্গানিজ সমৃদ্ধ খাবার হওয়ায় তা সরাসরি খনিজ উপাদানের সেরা উৎস হিসাবে কাজ করে। সবমিলিয়ে হাড়ের সুস্থতা বজায় রাখতে নির্দ্বিধায় ব্যবহার করা যেতে পারে এই লবঙ্গকে।

লবঙ্গের অপকারিতা 

লবঙ্গের উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার এই অংশে জানবো লবঙ্গের অপকারিতাগুলি কি কি সে-সম্পর্কে। লবঙ্গে সম্ভাব্য কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে। তৈরি করে: 

মাত্রাতিরিক্ত রক্তপাতের ঝুঁকি

শুরুতেই বলেছি লবঙ্গে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ইউজেনল যৌগ থাকে। আর এই বিশেষ যৌগ প্রাকৃতিক রক্ত পাতলা করে ফেলে। সুতরাং যাদের রক্তপাতজনিত ব্যাধি রয়েছে তারা কম পরিমাণে লবঙ্গ খাওয়ার চেষ্টা করবেন। পাশাপাশি যারা নিয়মিত অ্যান্টিকোয়াগুল্যান্ট বা অ্যান্টিপ্লেটলেট মেডিসিন গ্রহণ করেন তাদেরও লবঙ্গ খাওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা জরুরি।

সেইসাথে আপনাকে অবশ্যই নির্ধারিত অস্ত্রোপচার বা অপারেশনের অন্তত দুই সপ্তাহ আগে লবঙ্গ খাওয়া ছেড়ে দিতে হবে। নয়তো অপারেশনের সময় তা আপনার দেহ থেকে বাড়তি রক্ত বেরিয়ে আনবে। 

এলার্জির আধিক্য বেড়ে যাওয়া 

অতিরিক্ত লবঙ্গ খাওয়ার বিষয়টি ত্বকের ফুসকুড়ি, আমবাত, ফোলাভাব বা শ্বাস নিতে অসুবিধা সৃষ্টি করতে পারে। সুতরাং যদি আপনার সন্দেহ হয় যে আপনার লবঙ্গের অ্যালার্জি আছে, সেক্ষেত্রে তা আংশিক বাদ না দিয়ে পুরোপুরি বাদ দিতে হবে।

শ্বাসযন্ত্রে সমস্যা সৃষ্টি 

লবঙ্গে থাকা ধূলিকণা বা লবঙ্গ তেল থেকে ঘনীভূত ধোঁয়া নিঃশ্বাসের সাথে নিলে শ্বাসকষ্ট হতে পারে। বিশেষ করে যারা লবঙ্গ তৈরির কারখানায় কাজ করেন তাদের এ ব্যাপারে সতর্ক থাকা আবশ্যক। পাশাপাশি অতিরিক্ত লবঙ্গ খেলে নিশ্বাস নিতেও সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। এমনকি অনেকসময় এটিকে শ্বাস আটকিয়ে ফেলে মৃত্যু ঝুঁকিও বাড়াতে পারে।

বলা হয়ে থাকে শ্বাসকষ্ট, গলা ব্যথা বা কাশি হলে সরাসরি লবঙ্গ না খেয়ে বা না চিবিয়ে তা সিদ্ধ করে খাওয়াটাই উত্তম। 

গর্ভবতী নারীর সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে

লবঙ্গের উপকারিতা ও অপকারিতার ক্ষেত্রে অপকারিতার অংশ হিসাবে গর্ভবতী নারীর স্বাস্থ্যঝুঁকি বৃদ্ধির বিষয়টি জড়িত। বিশেষ করে বুকের দুধ খাওয়ানো মহিলাদের ক্ষেত্রে এটি ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। গবেষকদের মতে বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় কোনোভাবেই লবঙ্গ খাওয়া উচিত নয়। 

দাঁতের ক্ষতি করতে পারে

যদিও লবঙ্গকে দাঁতের ব্যথা এবং মাড়ির রোগ উপশমে ব্যবহার করা হয়! তবে আপনাকে সতর্ক থাকতে হবে যে লবঙ্গের অতিরিক্ত ব্যবহারও লাভের পরিবর্তে দাঁতের ক্ষতি করে বসতে পারে। দাঁত ছাড়াও লবঙ্গে থাকা ইউজেনল অতিরিক্ত ব্যবহার করলে তা পরবর্তীতে মুখের নরম টিস্যুর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। 

লবঙ্গ খাওয়ার নিয়ম

আপনি সহজেই অনেক খাবারের মধ্যে লবঙ্গ এড করে খেতে পারেন। লবঙ্গ বিশেষ করে ডেজার্ট, তরকারি বা চাটনিতে একটি স্বতন্ত্র স্বাদ আনতে ব্যবহার করা হয়। সুতরাং স্বাদের সাহায্যেও এটি খাওয়া যেতে পারে। এছাড়াও আপনি কিছু পুরো লবঙ্গ ফুটন্ত পানিতে ৫ থেকে ১০ মিনিটের জন্য সিদ্ধ করে এক কাপ লবঙ্গ চা তৈরি করতে পারেন। এই চা আপনাকে লবঙ্গের পুষ্টিগুণ সঠিক অবস্থাতেই গ্রহণ করতে সাহায্য করবে। 

শেষ কথা

মনে রাখবেন লবঙ্গের উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে সঠিক তথ্য জেনে তবেই আপনাকে লবঙ্গ খেতে হবে। অতি অল্প পরিমাণ লবঙ্গ গ্রহণ করলে যেমন এতে থাকা পুষ্টি উপাদান মিস করবেন, ঠিক তেমনই অতিরিক্ত লবঙ্গ খেলে তা আপনার দৈহিক সমস্যা সৃষ্টিতেও কাজ করবে।

তাছাড়া অন্যান্য খাবার বা মশলার মতো এতে থাকা সাইড এফেক্ট বিশেষ করে এলার্জির ব্যাপারটিও মনে রাখতে হবে। বিশেষ করে রং চা, খাবার, ভাত ইত্যাদির সাথে লবঙ্গ দিয়ে কেবল মাত্র এর ঘ্রাণ গ্রহণের চেষ্টা করুন। এতে করে লবঙ্গের সাইড এফেক্ট বেশ হালকাভাবেই কাজ করবে। 

 

লবঙ্গের উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কিত প্রশ্ন ও উত্তর / FAQ

১. লবঙ্গ তেল কিভাবে তৈরি করে?

উত্তরঃ লবঙ্গ তেল তৈরি হয় লবঙ্গের গুঁড়ার মাধ্যমে।

২. লবঙ্গ চিবিয়ে খেলে কি হয়?

উত্তরঃ লবঙ্গ চিবিয়ে খেলে কফ, দাঁতে ব্যাথা, সর্দি এবং কাশি দূর হয়।

৩. খালি পেটে লবঙ্গ খাওয়ার উপকারিতা কি? 

উত্তরঃ খালি পেটে লবঙ্গ খাওয়ার উপকারিতা হলো সর্দি এবং সাইনাসের সমস্যা দূরীকরণ!

৪. প্রতিদিন কয়টি লবঙ্গ খাওয়া উচিত?

উত্তরঃ প্রতিদিন সর্বোচ্চ ২ টি লবঙ্গ খাওয়া উচিত।

আরও পড়ুন-

কাঠবাদাম এর উপকারিতা

কাজু বাদাম খাওয়ার নিয়ম ও উপকারিতা

Leave a Comment