গর্ভবতী মায়েদের খাবার তালিকা ও খাবারের নিয়মাবলী

গর্ভবতী মায়েদের খাবার তালিকা

আপনি কি গর্ভবতী? আপনার কোলজুড়ে কি আসতে যাচ্ছে আপনার ছোট্ট সোনামণি? যদি তাই হয়,একজন গর্ভবতী মা হিসেবে আপনার প্রয়োজন বিশেষ যত্নের। খাবারের তালিকা থেকে শুরু করে আপনার চলাফেরা, ব্যায়াম সবকিছুতেই আপনার হতে হবে বিশেষ যত্নবান।

কেননা, একজন নারী গর্ভাবস্থায় আর একা নন তখন তিনি দুইজন হয়ে যান। গর্ভাবস্থার এই ৮-৯ মাসে একজন গর্ভবতী মায়ের খাবারের তালিকা একেকবার একেকরকম হওয়া উচিত।

মাস, সময় এবং শারিরীক অবস্থার উপর ভিত্তি করে একেকজন নারীর খাবারের তালিকা একেকরকম হওয়া খুবই প্রয়োজনীয়। একজন গর্ভবতী মায়ের খাবারের তালিকা হতে হবে সুষম, স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিসমৃদ্ধ। কারণ এই পৃথিবীতে মা-ই হচ্ছেন শিশুর জন্য বটবৃক্ষ। সুস্থ ও স্বাস্থ্যবান সন্তানের জন্য একজন মায়ের প্রচুর পরিমানে আমিষ, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন, খনিজ পদার্থ জাতীয় খাবার খেতে হবে।

গর্ভাবস্থার প্রথম তিনমাস অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এই সময়টাতে গর্ভবতী মায়ের খাবারে অরুচি, বমি বমি ভাব, অনেক ক্ষেত্রে ওজন কমে যাওয়া ও রক্তশূন্যতা দেখা দেয়।

তাই, গর্ভবতী মায়েদের খাবার তালিকা নিয়ে পরিবারের হতে হবে অনেক বেশি সচেতন, নিশ্চিত করতে হবে সুষম খাদ্য।

আরও পড়ুনঃ মাসিকের কতদিন পর গর্ভধারণ হয়, লক্ষণ ও চিকিৎসা

গর্ভবস্থায় তৃতীয় মাস কখন শুরু হয়

গর্ভবতী মায়েদের খাবার তালিকা

গর্ভবস্থায় তৃতীয় মাস ধরা হয় ৯-১২ সপ্তাহে।গর্ভবস্থার প্রথম তৃতীয় মাস অনেকবেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এই সময়টাতে গর্ভপাত হওয়ার আশংকা একটুবেশি থাকে। একারণেই এই সময়টাতে একজন গর্ভবতী মায়ের বিশেষ যত্নের প্রয়োজন পড়ে।

তবে ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই গর্ভবস্থার প্রথম তৃতীয় মাসে খাবার গ্রহণে, চলাফেরাই একটু সচেতন থাকলেই আর চিন্তা নেই।  

গর্ভবস্থার প্রথম তিন মাসের লক্ষণ

গর্ভবস্থার প্রথম মাসে একজন গর্ভবতী মায়ের মধ্যে বেশকিছু লক্ষণ দেখা যায়। তার মধ্যে সকালের অসুস্থতা, বমি বমি ভাব হওয়া অন্যতম।এছাড়াও এই সময়টাতে স্তন নরম হয়ে যাওয়া, ঘন ঘন প্রসাব হওয়া, ওজন কমে বা বেড়ে যাওয়া, মাথা ব্যাথা করা, বুক জ্বালা-পোড়া, ক্লান্তিভাব হয়।

গর্ভবতী মা যখন তিন নাম্বার মাসে প্রবেশ করেন তখন তার মধ্যে আরেকটি অন্যতম লক্ষন দেখা যায় আর সেটি হল  মেজাজের পরিবর্তন বা মুড সুয়িং হওয়া।একজন গর্ভবতী মায়ের মানসিক চাপমুক্ত থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।    

গর্ভবতী মায়েদের খাবার তালিকা – তিন মাস 

আপনার গর্ভে থাকা সন্তান প্রতিমাসেই একটু একটু করে বেড়ে ওঠে এবং তার বিভিন্ন ধরণের পরিবর্তন হয়। আপনার সন্তান আপনার গর্ভে থাকা অবস্থায় তার পরিপূর্ণ শারীরিক গঠন হয়ে থাকে। আর এই শারীরিক গঠনের জন্য আপনার সন্তানের প্রয়োজনীয় পুষ্টি সে আপনার খাদ্যগ্রহণ থেকেই হয়।

গর্ভবতী মায়েদের খাবার তালিকায় আয়রন, ভিটামিন সি, ফলিক এসিড, ভিটামিন ডি, ভিটামিন বি১২, ওমেগা-৩, ক্যালসিয়াম জাতীয় খাবার থাকা বাঞ্ছনীয়।

১। আয়রন জাতীয় খাবার

একজন গর্ভবতী মায়ের জন্য আয়রন জাতীয় খাবার অনেক বেশি প্রয়োজন। প্রতিদিনের খাবারের তালিকায় আয়রন জাতীয় খাবার কোনভাবেই বাদ দেয়া যাবেনা। কেননা, আয়রন গর্ভে থাকা সন্তানের বিকাশে সাহায্য করে।

তার পাশাপাশি আপনি যখন সন্তান প্রসব করবেন তখন আয়রনের কারণে রক্তপাতের পরিমাণ কম হবে। শরীরে আয়রনের প্রয়োজন মেটাতে একজন গর্ভবতী মায়েদের খাবার তালিকায় অবশ্যই পালংশাক, কচুশাক, সামুদ্রিক মাছ, খেজুর,কিসমিস, বাদাম, আপেল,ডার্ক চকলেট যুক্ত করবেন।

প্রতিদিন খাবারের সাথে অবশ্যই দুই থেকে তিনটি খেজুর, কিসমিস এবং একটি আপেল খাবেন। এগুলো আপনার শরীরের শুধু আয়রনের চাহিদাই নয় ক্যালসিয়ামের চাহিদাও পূরণ করবে।

২। ভিটামিন সি জাতীয় খাবার

ভিটামিন সি জাতীয় খাবার একজন গর্ভবতী মায়ের জন্য অত্যন্ত জরুরী। যেহেতু গর্ভবতী মায়ের প্রথম তিনমাসে বমি বমি ভাব হয়, বমি হয় এবং মাথা ঘুরায়, তাই ভিটামিন সি জাতীয় খাবার খাওয়া গর্ভবতী মায়ের জন্য অত্যন্ত জরুরী।

ভিটামিন সি পেতে কমলা বা মালটা, আমড়া, পেয়ারা, ফুলকপি, কাঁচা মরিচ, যেকোন ধরণের টকজাতীয় ফল, ক্যাপসিকাম খেতে হবে। তাছাড়াও ডাক্তাররা গর্ভবতী মায়েদের খাবার তালিকায় দুইটি রঙ্গিন ফল রাখতে বলেন। যেহেতু মালটা সারাবছর পাওয়া যায় তাই প্রতিদিন গর্ভবতী মায়ের উচিত দুইটি করে মালটা খাওয়া। 

কাঁচা মরিচ যেহেতু সারাবছরই পাওয়া যায় এবং সবার ঘরেই থাকে তাই চেষ্টা করবেন প্রতিদিন একটি করে কাঁচা মরিচ খেতে। 

৩। ফলিক এসিড

ফলিক এসিড একজন গর্ভবতী মা ও তার গর্ভে থাকা সন্তানের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। এই ফলিক এসিড একদম গর্ভকালীন সময়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গ্রহণ করতে হয়।

ডাক্তারের শরণাপন্ন হলে ডাক্তার আপনার শারিরীক অবস্থা বিবেচনা করে ফলিক এসিডের ডোস কমবেশি ওষুধ আকারে খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তবে এটি আপনি বিভিন্ন খাদ্য থেকেও গ্রহণ করতে পারেন।

যেমনঃ মালটা, পাকা কলা, মধু, দুধ, সবুজ ও রঙ্গিন শাক-সবজি, মসুর ডাল,কড়াইশুঁটি, মটর, সয়াবিন ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণে ফলিক এসিড থাকে যা গর্ভবতী মায়ের জন্য অত্যন্ত উপকারী। একজন গর্ভবতী মায়ের প্রতিদিন ৪০০-৬০০ মাইক্রোগ্রাম ফলিক এসিড গ্রহন করা উচিত। 

৪। প্রোটিন জাতীয় খাবার

গর্ভবতী মায়েদের খাবার তালিকায় অবশ্যই প্রোটিন জাতীয় খাবার রাখতেই হবে।প্রতিদিন অবশ্যই একটি করে ডিম এবং সম্ভব হলে দুইটি করে ডিম খাওয়া উচিত গর্ভবতী মায়ের। কেননা, ডিমে থাকা কোলিন শিশুর বুদ্ধি ও বিকাশের জন্য উপযোগী।

তবে আপনার যদি ডিম খেতে কষ্ট হয় তাহলে ডিমের বানানো নাস্তা খেতে পারেন।  তাছাড়াও মুরগি, দেশি মাছ, ডাল, মটর, বাদাম, শিম,দুধ,দই প্রতিদিন খাবেন। অনেক গর্ভবতী মায়েরা আছেন যারা প্রথম তিন মাসে অনেক ধরণের খাবারই খেতে পারেন না কষ্ট হয়।

তাদের জন্য ছোট একটি টিপস হলোঃ আপনি মুরগি,ডিম, নানা ধরনের সবজি,বাদাম মিক্সড করে হালকা একটু ব্লাক পেপার, ওয়াইট পেপার, লবণ দিয়ে খাবেন। খেতেও সুস্বাদু লাগবে এবং সকল পুষ্টি উপাদানও পাবেন। একজন গর্ভবতী মায়ের প্রথম তিন মাসে কমপক্ষে প্রতিদিন ১০০ গ্রাম প্রোটিন গ্রহন করা উচিত। 

৫। ক্যালসিয়াম জাতীয় খাবার

ক্যালসিয়ামের উপকারিতা সমন্ধে আমরা কমবেশি সবাই অবগত। ক্যালসিয়াম জাতীয় খাবার আপনার গর্ভে থাকা সন্তানের দাত,মস্তিষ্ক, হাড় গঠনে এবং মজবুত করতে সহায়তা করবে। একজন গর্ভবতী মায়ের প্রতিদিন অবশ্যই এক গ্লাস করে দুধ খাওয়া উচিত।

তবে দুধ খেতে যদি অসুবিধা হয় তখন দুধ দিয়ে বানানো যেকোন নাস্তা এবং দই খেতে পারেন। তবে অবশ্যই ঠান্ডাজাতীয় খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকবেন বিশেষ করে শুরুর তিনমাস। প্রতিদিন খাবারের তালিকায় ছোট মাছ যুক্ত করবেন কেননা ছোট মাছেও প্রচুর পরিমানে ক্যালসিয়াম রয়েছে।

এমনকি ভিটামিন ডি গর্ভকালীন পুরোটা সময়েই অনেক বেশি প্রয়োজনীয়। ভিটামিন ডি শুধু খাবারের সময়েই না শরীরেও এর ছোয়া লাগাবেন। প্রতিদিন ৩০ মিনিট করে সূর্যের আলো আপনার শরীরে লাগাবেন।

শেষ কথা

পরিশেষে একটি কথাই বলা যায়, একজন গর্ভবতী মায়ের প্রচুর পরিমানে পুষ্টি ও ক্যালোরি প্রয়োজন। তাই কোন খাবারই বাদ দেয়া উচিত নয়। যদিও কিছু কিছু ফল বেছে খাওয়া উচিত।

গর্ভবতী মায়ের প্রথম তিন মাসের খাবারের তালিকায় লাল চালের ভাত, লাল আটার রুটি,পাস্তা, আলু, সবুজ শাক-সবজি, ভেজিটেবল স্যুপ, চিকেন স্যুপ, দুধ, মুরগি, ডিম, রঙ্গিন ফল-মূল, বাদাম, ডাল, দই, পনির, মাখন, ছোট মাছ, কলা, খেজুর ইত্যাদি নিয়মিত খাওয়া উচিত। আর অবশ্যই প্রচুর পরিমানে পানি খেতে হবে।

গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাসে খাবারে অনেক অরুচি দেখা যায় তাই এই সময়টাতে আপনি অল্প অল্প করে একটু পর পর খাবার খাবেন এতে করে আপনি শরীরে শক্তি পাবেন এবং আপনার বাচ্চাও ভালো থাকবে। 

গর্ভবতী মায়েদের খাবার তালিকা সম্পর্কিত প্রশ্ন ও উত্তর / FAQ: 

১।গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাসে দুধ কখন খাওয়া উচিত? 

উত্তরঃ দুধ আপনি যেকোন সময়েই পান করতে পারবেন।চাইলেই সকালের নাস্তায় বা রাতে খাবারের পরে অথবা, কলা, দুধ, বাদাম ও খেজুর মিক্সড করে ব্লেন্ডারে ব্লেন্ড করে বিকালেও খেতে পারেন। 

২। গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাসে  কোন বাদাম  খাওয়া উচিত?

উত্তরঃ গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাসে কাজু বাদাম, আনমন্ড, চিনা বাদাম খাওয়া যাবে। 

৩। গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাসে কোন খাবারগুলো না খাওয়া ভালো? 

উত্তরঃ কিছু কিছু খাবার আছে যা গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাসে না খাওয়াই উত্তম। যেমনঃ আনারস, কাচা পেপে, আধা সিদ্ধ ডিম, আধা সিদ্ধ মাছ, সুসি, নানা ধরনের সস, অতিরিক্ত মিষ্টি জাতীয় খাবার, ফাস্ট ফুড, পরিমানের চেয়ে বেশি ভিটামিন-এ,অ্যালকোহল, ক্লোড ড্রিংক্স,অতিরিক্ত ক্যাফেইন ইত্যাদি খাওয়া উচিত নয়। অনেক গর্ভবতী নারীকে ডাক্তার গাজরও খেতে না করে থাকেন।

৪। গর্ভবতী মায়ের খাবার কিভাবে তৈরি করা ভালো হবে? 

উত্তরঃ অবশ্যই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা মেনে রান্না করা উচিত। বাইর থেকে আনা বা খোলা পরিবেশের অনেক তেল মসলা দেয়া খাবার এবং অনেকদিন ধরে ফ্রীজে রাখা খাবার গর্ভবতী মাকে দিবেন না।

আরও পড়ুন-

বুকের কফ বের করার ঔষধ নাম ও সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতি

সহবাসের নিয়ম নীতি, করনীয় ও প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা


Leave a Comment