ঋণ থেকে মুক্তির দোয়া, আমল ও নাজাতের পদ্ধতি

ঋণ থেকে মুক্তির দোয়া 

মুমিন ব্যক্তির কাছে ঋণের বোঝার চেয়ে ভারী কোন বোঝা আর নেই। রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন – “তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম ; যে উত্তমরূপে ঋণ পরিশোধ করে।” আর্থিক দুরাবস্থার কারণে ঋণ নিতে বাধ্য হয় মানুষ। কিন্তু সাধ্যের বাইরে ঋণ দেওয়া এবং নেওয়া দুটোই ইসলামে নিষেধ আছে।

সাধ্যের বাইরে ঋণ করলে সময়মতো সেই ঋণ পরিশোধ করার সম্ভাবনা কমে যায়। যার ফলে ঋণগ্রহীতা যেমন হতাশায় ভোগে ঠিক তেমনি ঋণদাতাও নাজেহাল হয়। কারণ ঋণগ্রহীতা একের পর এক অজুহাত দিতেই থাকে। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ঋণে জড়ানোর ব্যাপারে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন আল্লাহর কাছে।

উম্মুল মুমিনিন হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত : রাসুলুল্লাহ (সা:) সালাতে এই বলে দোয়া করতেন – “হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে গুনাহ ও ঋণ থেকে পানাহ চাচ্ছি। এক প্রশ্নকারী জিজ্ঞাসা করল, (হে আল্লাহর রাসূল) আপনি ঋণ থেকে বেশি বেশি পানাহ চান কেন?

রাসুলুল্লাহ (সাঃ) জবাব দিলেন – মানুষ ঋণগ্রস্ত হলে মিথ্যা বলে এবং ওয়াদা ভঙ্গ করে।” (বুখারী : ২৩৯৭) যখন কোন ব্যক্তি অতিমাত্রায় ঋণগ্রস্ত হয় তখন সে মানসিক অস্থিরতা এবং দুশ্চিন্তায় ভোগে। হতাশা এবং দুশ্চিন্তা আত্মহত্যার মতো জঘন্য কাজের দিকেও ঠেলে দিতে পারে।

যদি ঋণদাতা মাফ না করে তাহলে মুক্তির কোন উপায় নেই। হাদিস অনুযায়ী, যদি ঋণদাতা ঋণগ্রস্থের ঋণ মাফ করে দেয় তাহলে সে আখিরাতে একটি বড় পুরস্কার পাবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে ঋণ থেকে মুক্তির দোয়া আছে কি? হ্যাঁ, অবশ্যই আছে। আমাদের জীবনের সকল সমস্যার সমাধান ইসলামে রয়েছে।

আজকের আর্টিকেলের আলোচনার বিষয় হচ্ছে ঋণ থেকে মুক্তির দোয়া। ঋণগ্রস্থ ব্যাক্তিরা অবশ্যই চেষ্টা করবেন আল্লাহর উপর বিশ্বাস রেখে দোয়াগুলো আমল করার। ঋণ পরিশোধ করার মনোবল এবং ঋণমুক্তির দোয়াগুলো সঠিকভাবে আমল করলে ইনশাআল্লাহ আপনার ঋণ পরিশোধ হয়ে যাবে। 

আরও পড়ুনঃ ফিতরা দেওয়ার নিয়ম ও পদ্ধতি

ঋণ থেকে মুক্তির দোয়া – ১ 

ঋণমুক্ত হতে সক্ষম হওয়া এবং দ্রুত ঋণ পরিশোধ করার জন্য মহানবী (সা:) কিছু আমল এবং দোয়া শিক্ষা দিয়েছেন। হাদিসে বর্ণিত আছে – “একবার হযরত আলী (রা:) এর কাছে একজন চুক্তিবদ্ধ গোলাম (ক্রীতদাস) এসে বলে, আমার চুক্তির অর্থ পরিশোধ করতে আমি অপারগ হয়ে পড়েছি।

আপনি আমাকে সাহায্য করুন। আলী (রা:) বললেন, আমি কি তোমাকে কয়েকটি শব্দ শিক্ষা দিব, যা আমাকে রাসূল (সা:) শিক্ষা দিয়েছেন? তুমি যদি এটা পাঠ কর, তাহলে আল্লাহই তোমার ঋণ মুক্তির ব্যাপারে দায়িত্ব নেবেন, যদি তোমার ঋণ পর্বত সমানও হয়।” অতঃপর হযরত আলী (রা:) ওই ব্যক্তিকে নিম্নোক্ত দোয়াটি পড়তে বলেছিলেন। দোয়াটি হল – 

 اللَّهُمَّ اكْفِنِي بِحَلاَلِكَ عَنْ حَرَامِكَ، وَأَغْنِنِي بِفَضْلِكِ عَمَّنْ سِوَاكَ

উচ্চারণ : “আল্লা-হুম্মাকফিনী বিহালা-লিকা ‘আন হারা-মিকা ওয়া আগনিনী বিফাদ্বলিকা ‘আম্মান সিওয়াক।” 

অর্থ : “হে আল্লাহ ! হারামের পরিবর্তে তোমার হালাল রুজি আমার জন্য যথেষ্ট কর। আর তোমাকে ছাড়া আমাকে কারো মুখাপেক্ষী করোনা এবং স্বীয় অনুগ্রহ দ্বারা আমাকে স্বচ্ছলতা দান করো।” (তিরমিজি শরীফ, হাদিস : ৩৫৬৩) 

ঋণ থেকে মুক্তির দোয়া – ২ 

হাদিসে বর্ণিত আছে : “হযরত আবু সাঈদ খুদরি (রা:) বলেন – একদিন রাসুলুল্লাহ (সাঃ) মসজিদে নববীতে প্রবেশ করে আনসারী একজন লোককে দেখতে পেলেন, যার নাম আবু উমামা। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তাকে বললেন – আবু উমামা! ব্যাপার কি, নামাজের সময় ছাড়াও তোমাকে মসজিদে বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে? আবু মামা বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! অনেক ঋণ এবং দুনিয়ার চিন্তা আমাকে গ্রাস করে রেখেছে।

তখন রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বললেন – আমি কি তোমাকে এমন কিছু কালিমা শিখিয়ে দিব, যেগুলো বললে আল্লাহ তা’আলা তোমার চিন্তাকে দূর করে দিবেন এবং তোমার ঋণ গুলো আদায় করে দিবেন? অতঃপর আবু উমামা বললেন, জ্বী হ্যাঁ ইয়া রাসুলুল্লাহ! অবশ্যই বলুন।

তখন রাসুলুল্লাহ (সাঃ) নিম্নোক্ত দোয়াটি শিখিয়ে দেন এবং তা সকাল সন্ধ্যায় পড়তে বলেন। আবু উমামা বলেন – আমি রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর শিখানো দোয়াটি পড়তে লাগলাম। ফলে আল্লাহ তা’আলা আমার চিন্তা দূর করে দিলেন এবং আমার ঋণগুলোও আদায় করে দিলেন।” দোয়াটি হল – 

اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْهَمِّ وَالْحَزَنِ، وَالْعَجْزِ وَ أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْبُخْلِ وَالْجُبْنِ، وَ أَعُوذُ بِكَ مِنَ ضَلَعِ الدَّيْنِ، وَغَلَبَةِ الرِّجَالِ

উচ্চারণ : “আল্লাহুম্মা ইন্নি আউযু বিকা মিনাল হাম্মি ওয়াল হাযানি, ওয়া আউযু বিকা মিনাল বুখলি ওয়াল জুবনি, ওয়া আউযু বিকা মিন দ্বালা’য়িদ্দাইনি ওয়া গালাবাতির রিজাল।”  

অর্থ : “হে আল্লাহ! নিশ্চয়ই আমি দুশ্চিন্তা ও দুঃখ থেকে আপনার আশ্রয় চাই, অপারগতা ও অলসতা থেকে আপনার আশ্রয় চাই, কৃপণতা ও ভীরুতা থেকে আপনার আশ্রয় চাই আর ঋণের ভার ও মানুষদের দমন-পীড়ন থেকেও আপনার আশ্রয় চাই।” ( সহীহ বুখারী, হাদিস : ২৮৯৩) 

ঋণমুক্তির সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা এবং সঠিক নিয়ত করতে হবে। চেষ্টা করবেন সালাত আদায় করার সময় দুই সিজদার মাঝে বসে উপরোক্ত ঋণ থেকে মুক্তির দোয়াটি বেশি করে পড়ার। বিশুদ্ধ নিয়তে আল্লাহর কাছে ঋণমুক্তির জন্য আশ্রয় প্রার্থনা করলে ইনশাআল্লাহ মহান আল্লাহ তা’আলা ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিদেরকে ঋণ থেকে মুক্তি দিবেন। 

ঋণ থেকে মুক্তির দোয়া – ৩ 

মহানবী (সা:) প্রায় সময় আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন। দোয়াটি হলো – 

اللهم إني أعوذ بك من الكسل والهرم والمأثم والمغرم

উচ্চারণ : “আল্লাহুম্মা! ইন্নি আউযুবিকা মিনাল কাসালি, ওয়াল হারামি, ওয়াল মা’ছামি, ওয়াল মাগরামি।” 

অর্থ : “হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে অলসতা, অধিক বার্ধক্য, গুনাহ এবং ঋণ হতে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।” (বুখারী : ৬০০৭) 

শেষকথা 

প্রকৃতপক্ষে ঋণ করা কারো জীবনেই সুখকর বিষয় নয়। তবে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়ে বাধ্য হয়েই অনেকে ঋণ করে। তবে সাধ্যের বাইরে ঋণ করা কোন ভাবেই কাম্য নয় একজন মুমিনের ক্ষেত্রে। ঋণগ্রস্ত হলে কিভাবে এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে সেই উপায় খুঁজে বের করতে হবে।

ঋণ পরিশোধ করার স্বদিচ্ছা এবং দোয়া গুলো ভালোভাবে আমল করতে হবে। ইনশাআল্লাহ আল্লাহ তায়ালা সকল প্রকার ঋণ থেকে মুক্ত করে দিবেন। নবী করিম (সাঃ) বলেছেন, “ঋণ পরিশোধ না করা কবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত।” বুঝতেই পারছেন ঋণ পরিশোধ না করা কত মারাত্মক। ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির প্রথম এবং প্রধান আমল হচ্ছে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতে হবে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আমাদের প্রাপ্তবয়স্ক প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরজ।

দ্বিতীয় আমল হচ্ছে, আত্মীয়দের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা। তৃতীয় আমল হচ্ছে, যখনই নামাজ আদায় করবেন তখনই আল্লাহর কাছে ঋণ থেকে মুক্তির দোয়া করতে হবে। দোয়া কবুলের সময়গুলোতে বেশি করে দোয়া করতে হবে। তাহাজ্জুতের সময় হচ্ছে দোয়া কবুলের উত্তম সময়। তাই চেষ্টা করবেন এই সময় তাহাজ্জুতের নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে ঋণ মুক্তির জন্য সাহায্য চাওয়া। উপরের আমলগুলা মেনে চললে আশা করছি আল্লাহ তায়ালা আপনাকে নিরাশ করবেন না ইনশাল্লাহ। 

ঋণ থেকে মুক্তির দোয়া সম্পর্কিত প্রশ্ন এবং উত্তর / FAQ

১. ঋণ রেখে মারা গেলে কি হয়? 

উত্তর : হাদিসে আছে – “তবে কোন ব্যক্তি যদি ঋণ রেখে মারা যায়, তাহলে মৃতের সব সম্পদ বিক্রি করে হলেও পরিবারকে ঋণ পরিশোধ করতে হবে।” (বুখারী : ২৪৪৯) 

এই বিষয়ে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন – “মৃতের ওসিয়ত পূরণ করার পর এবং তার ঋণ পরিশোধের পর (তার সম্পত্তি বন্টিত হবে)।” (সূরা নিসা : ১১)  

অবশ্য নিজের ব্যক্তিগত সম্পত্তি থেকে মা-বাবার ঋণ পরিশোধ করা সন্তানের জন্য আবশ্যক নয়। (মিনহাজুস সুন্নাহ : ৫/২৩২)। তবে ব্যক্তিগত সম্পত্তি থেকে ঋণ পরিশোধ করতে পারলে অশেষ সওয়াব মিলবে।  

২. ঋণ কি ইসলামে বৈধ? 

উত্তর : হ্যাঁ, ঋণ ইসলামে বৈধ। “ঋণ প্রথা বৈধ যা সুন্নত এবং ইজমা (ঐক্যমত) দ্বারা প্রমাণিত। (মুগনী, ইবনু কুদামাহ, ৬/৪২৯) 

৩. কোন সূরায় ঋণ সম্পর্কে বলা হয়েছে? 

উত্তর : পবিত্র কোরআন শরীফের “সূরা আল বাকারা” তে ঋণ সম্পর্কে বলা হয়েছে। 

আরও পড়ুন-

স্বামীকে কিভাবে আদর করতে হয়, দায়িত্ব ও কর্তব্য

নামাজ ফরজ কেন? নামাজ পড়ার নিয়ম

Leave a Comment