৭ দিনে চুল লম্বা করার উপায়
একরাশ ঘন কালো চুল আমাদের নজর কেড়ে নেয় নিমিষেই। সুন্দর স্বাস্থ্যোজ্জ্বল চুল আমাদের সবারই প্রিয়। চলুন জেনে নেওয়া যাক ৭ দিনে চুল লম্বা করার উপায়। চুলের সঠিক যত্ন বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ দুইই হওয়া উচিত। চুলের যথাযথ পুষ্টির অভাব হলে চুল ও মাথার ত্বক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। স্বাস্থ্যোজ্জ্বল চুল আমাদের আত্নবিশ্বাস বাড়িয়ে তোলে কয়েকগুণ। কোন পরিশ্রম না করে কখনই চুলের সর্বপরি সুস্বাস্থ্য আশা করা যায় না, হ্যা অনেকেই আছে যাদের চুল জন্মগতভাবে এবং প্রাকৃতিক ভাবেই বেশ ঝলমলে এবং সুন্দর তবে সবার ক্ষেত্রে বিষয়টি এক নয়। চুল বয়স, খাদ্যাভ্যাস, পরিবেশভেদে লম্বা- ছোট, রুক্ষ- সৃন হতে পারে।
আমাদের কাঙ্ক্ষিত চুল পাবার জন্যে অনেক প্রয়াস আমাদের মা-খালাসহ তাদের দাদী-নানীদের আমল থেকে হয়ে আসছে। তাদের চুলের যত্নে ব্যবহৃত টোটকায় কোন ক্ষতিকর ক্যামিক্যাল থাকত না, সবই প্রাকৃতিকভাবে পরিক্ষিত উপাদান যা আসলেই চুলের মজবুত ও স্বাস্থ্য রক্ষায় বিপুল কার্যকরী হয়েছে। কিন্তু আজকের এই ডিজিটাল আর নানান ক্যামিক্যালের যুগে আমরা ভুলতে বসেছি প্রাকৃতিক সব জাদুকরী উপাদানের কথা যা আমাদের ক্ষতিকর পদার্থ থেকে রক্ষা করতে পারে। চুল লম্বা করার উপায় দেশ, জাতি ও সংস্কৃতি ভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে।
প্রতি শতকরা ৭০% মানুষের চুলের কোন না কোন সমস্যা অবশ্যই রয়েছে। চুলের সমস্যা নেই এমন মানুষ খুজে পাওয়া যাবে না। জীবনের নির্দিষ্ট সময়ে বা কোন পরিবর্তনের সময়ে চুল বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গবেষণার মাধ্যমে বেশ কিছু চুলের সমস্যার কথা আমরা জেনেছি এবং ৭ দিনে চুল লম্বা করার উপায় সেগুলোই আজ এখানে আলোচনা করব।
আরও পড়ুনঃ মেয়েদের ওজন কমানোর ব্যায়াম
চুল বড় করার উপায়
খুশকিযুক্ত চুলঃ শীতে বা সারা বছর অনেকের খুশকি হয়ে থাকে চুলে। খুশকি আমাদের মাথার ত্বকের মরা চামড়া। এগুলো পরে ধীরে ধীরে দানাদার খুশকি রুপে ত্বকে দেখা যায়।
চুল পড়াঃ চুল ঝরে যাওয়া বা পাতলা হয়ে যাওয়া। এলোপেসিয়ার কারনে অনেকের চুল পাতলা হয়ে আসে,বিশেষ করে সামনের দিকে।
রুক্ষ চুলঃ অতিরিক্ত শ্যাম্পু করার কারনে চুলের প্রাকৃতিক তেল চুল থেকে সরে যেতে থাকে এর ফলে চুল রুক্ষমূর্তি ধারন করে।
চুলের আগা ফাটাঃ চুল অতিরিক্ত আচড়ালে, বেশি গরম কোন কিছু ব্যবহার যেমন- হেয়ার ড্রায়ার, হেয়ার স্ট্রেইটনার, হেয়ার কার্লিং আয়রন, হিট প্রটেক্টিভ স্প্রে ব্যবহার না করলে চুলের আগা ফেটে দুমুখো চুল বের হয়ে যায়। পরে এই চুল আস্তে আস্তে ফেটে উর্ধমুখী হতে থাকে।
তৈলাক্ত বা চিটচিটে চুলঃ চুল অতিরিক্ত তৈলাক্ত হয় যখন মাথার ত্বক বা তালু থেকে প্রাকৃতিক তেল নিঃসৃত হয়। এই প্রাকৃতিক তেলকে বলা হয় সিবাম (Sebum)। সিবাম সেবেসিয়াস (Sebaceous) গ্রন্থি দ্বারা উৎপাদিত যা হঠাৎ করে অতিরিক্ত ক্ষরণ হয়ে থাকে। যার ফলে পরিমানের চেয়ে বেশি তেল নিঃসৃত হয়।
উষ্কোখুষ্কো চুলঃ চুলের মসৃণতা ধীরে ধীরে কমে গেলে চুল উষ্কোখুষ্কো হতে থাকে।
ক্ষতিগ্রস্ত চুলঃ চুলে গরম তাপযুক্ত যেকোনো পন্য ব্যবহার করলেই চুলের ক্ষতি হতে পারে।
চুলে রং করালেঃ চুলে অপ্রাকৃতিক রং (Synthetic Color) করালে এবং নিয়মিত যত্ন না নিলে কালারে ব্যবহৃত ক্যামিক্যাল চুলের বেশ ক্ষতি করতে পারে। চুল হারাতে পারে তার স্বাভাবিক জৌলস, চুল ভেঙ্গে যেতে পারে।
চুল ভেঙ্গে পরাঃ অপুষ্টিজনিত কারনে চুলের অনেকগুলো ক্ষতির মধ্যে একটি হলো চুল আগা থেকে ফেটে মাঝখানে ভেঙ্গে যাওয়া।
চুল অকালে পেকে যাওয়াঃ বয়স হলে চুল পাকবে এটা সত্য কথা। কিন্তু যদি বয়স হবার আগেই চুল কিছুটা পেকে যায় তাহলে বুঝতে হবে এটি চুলের সমস্যা।
চুল লম্বা করার উপায়
সঠিক খাবার
চুল মানুষের সৌন্দর্যের অন্যতম একটি অনুষঙ্গ। অনেকেই চুলকে নানানভাবে সাজিয়ে নানান রূপ দিতে পছন্দ করেন। আবার কেউ পছন্দ করেন চুল লম্বা রাখতে, কেউবা রাখেন ছোট। যারা লম্বা চুল রাখতে পছন্দ করেন তারা কিছু নিয়ম মেনে চললে স্বাস্থ্যবান লম্বা চুল ফিরে পেতে পারেন।
- ডিম- ডিম প্রোটিন এবং বায়োটিনের গুরুত্বপূর্ণ উৎস। এই দুইটি উপাদান চুলের বৃদ্ধির জন্যে অবশ্য জরুরি। বায়োটিন ক্যারাটিন সমৃদ্ধ যা চুলের প্রোটিনের জন্যে অপরিহার্য।
- পালং শাক- পালং শাকে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে উপকারি পুষ্টিগুণ যেমন পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ফলিক অ্যাসিড, আয়রন, ভিটামিন এ এবং সি যা চুলের বৃদ্ধি ঘটায়। প্রতিদিন ৩০ গ্রাম পালং শাক ২০% ভিটামিন এ এর অভাব পূরন করে।
- চর্বি বা তেলযুক্ত মাছ- তেলযুক্ত মাছে থাকে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড, ভিটামিন ডি, ভিটামিন ডি ৩, সেলেনিয়াম, ভিটামিন বি, প্রোটিন যা স্বাস্থ্যোজ্জ্বল চুলের জন্যে উপকারী।
- বাদাম- বাদামে যথেষ্ট পুষ্টিগুণ রয়েছে যেমন ভিটামিন বি, জিঙ্ক এবং প্রয়োজনীয় ফ্যাটি এসিড। বাদাম চুলের বৃদ্ধি ও উজ্জ্বলতা ধরে রাখতে সাহায্য করে।
- সবুজ শাকসবজি- সার্বিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি চুলের স্বাস্থ্যের জন্যে সবুজ শাকসবজির বিকল্প নেই। এতে থাকে অনেকগুলো ভিটামিন ও আয়রন যা চুলের বৃদ্ধি ঘটায়।
আরও পড়ুনঃ মেয়েদের জন্য ৬টি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাশন টিপস
সঠিক শ্যাম্পু নির্বাচন
চুল পরিষ্কারের জন্যে ক্ষতিকর ক্যামিক্যালমুক্ত শ্যাম্পু ব্যবহার করা উচিত নয়। শ্যাম্পু কেনার সময় শ্যাম্পুর গায়ে লেখা উপাদান খেয়াল করে দেখুন। যদি তাতে SLS (Sodium Lauryl Sulphate), SLES (Sodium Laureth Sulfate), প্যারাবিনস, সিলিকন পদার্থ থেকে থাকে তাহলে সেই শ্যাম্পু এড়িয়ে চলুন। এই উপাদানগুলো মাথার ত্বকে বাসা বাধতে পারে এবং চুলের ফলিকলগুলোকে আটকে দিতে পারে যা চুলের বৃদ্ধিতে ব্যাঘাত ঘটায়।
অতিরিক্ত তাপের কারনে হওয়া ক্ষতি
চুলের সৌন্দর্য বর্ধনে অনেকেই অতিরিক্ত তাপযুক্ত হেয়ার ড্রায়ার, হেয়ার স্ট্রেইটনার, কার্লিং আয়রন ব্যবহার করে থেকে যা চুলের বেশ ক্ষতি করে ফেলে, চুলের বৃদ্ধিতে দারুন সমস্যা সৃষ্টি করে। এসব ব্যবহার বন্ধ করলে চুলের বৃদ্ধি পাওয়া সহজ হবে।
চুল রং না করা
চুল রং করার সময় রং দীর্ঘস্থায়ী করার জন্যে অনেক ক্যামিক্যালযুক্ত উপাদান ব্যবহার করা হয় যা পরবর্তীতে চুলের ভেঙ্গে যাওয়া, ঝরে যাওয়া, চুল পরে যাওয়া ইত্যাদি সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। চুলে ক্যামিক্যাল ব্যবহার না করে প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করা উচিত।
প্রতি তিন মাসে একবার চুল কাটা
চুলের আগায় নির্দিষ্ট সময়ের পর ফাটা হওয়া শুরু করে, এই ফাটা আস্তে আস্তে উপরের দিকে ধাবিত হয় তাই প্রতি তিন মাসে একবার চুল ট্রিম করা উচিত, এতে চুলের বৃদ্ধি ঘটে।
চুলে নিয়মিত তেল মালিশ
তেল মালিশ করলে মাথার ত্বকের রক্ত সঞ্চালন বাড়ে আর নতুন চুলও গজায়। ২ কাপ নারিকেল তেল, ২ চা চামচ রেডির তেল (Castor Oil), ২ চামচ বাদামের তেল (Almond Oil) এবং আগে থেকে গাছ থেকে তুলে ধুয়ে রোদে শুকিয়ে রাখা নিম পাতা এক সাথে করে অল্প আঁচে জ্বাল দিতে হবে। নিম পাতার রং গাঢ় হলে চুলা থেকে নামিয়ে সংরক্ষন করতে হবে। প্রত্যেক সপ্তাহে অন্তত দুবার সময়মত তেল মাথার তালুতে মালিশ করতে হবে। এতে চুল লম্বা ও ঘন হবে।
পেয়াজের রস
থেতলে নেওয়া পেয়াজের রস আলাদা করে তেলের সাথে মিশিয়ে জ্বাল করে সংরক্ষন করে সেই তেল নিয়মিত মাথায় মালিশ করলে চুল দীর্ঘ হবে বলে আশা করা যায়। পেয়াজে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে সালফার ও পটাশিয়াম যা চুলের জন্যে স্বাস্থ্যকর।
অ্যালোভেরা
অ্যালোভেরায় রয়েছে অনেক রকমের সক্রিয় উপাদান ও মিনারেলস যা চুল মজবুত করনের পাশাপাশি চুল পরা রোধ ও চুলের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। এতে রয়েছে ফ্যাটি এসিড, এমিনো এসিড, প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ, বি ১২, সি এবং ই। এটি সরাসরি অথবা তেলের সাথে মিশিয়ে ব্যবহার করা যায়।
পর্যাপ্ত ঘুম
দৈনিক ৮-৯ ঘন্টা ঘুম মানব শরীরের জন্য অত্যন্ত দরকারি। পর্যাপ্ত ঘুম শরীরে মেলাটোনিন উৎপাদনে সাহায্য করে যা চুলের বৃদ্ধির সাথে যুক্ত। নিয়ম করে রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পরলে এবং সকালে উঠে পরলে শরীর, মন ও সার্বিক দিক থেকে ভালো।
নিজের ডায়েট নিয়ন্ত্রণে রাখা
ডায়েট করা মানেই না খেয়ে থাকা নয়, শরীরের বৃদ্ধিতে খাদ্যের ছয়টি উপাদানেরই প্রয়োজন রয়েছে। এই উপাদানগুলো প্রতিদিনের খাদ্যে রাখা উচিত। কঠিন কোন ডায়েট অনুসরণ না করে অল্প করে সব ধরনের পুষ্টিকর খাবার নিয়মিত খেলে চুলের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হবে।
সবশেষে বলা যায় যে, চুল আমাদের সৌন্দর্যকে কয়েকাংশে বাড়িয়ে দেয়। চুলের যত্নে হাজার হাজার টাকা আমরা পার্লার বা স্যালনে খরচ করি অথচ এর যত্ন করার উপায় আমাদের মধ্যেই লুকিয়ে আছে। পরিমিত খাবার, সঠিক সময়ের পর্যাপ্ত ঘুম, চুল সঠিক নিয়মে ধৌত করা, তেল মালিশ করলে, প্রোটিন জাতীয় খাবার গ্রহন করলে ৭ দিনে চুল লম্বা করার উপায় পাবেন সুন্দর মোলায়েম ভাব যা আপনার মুখে হাসি ফোটাবে। আসুন আমরা প্রাকৃতিকভাবে চুলের যত্নে অভ্যস্ত হই।