মাসিক বন্ধ হলে কি করতে হবে
প্রতিমাসে মেয়েদের যোনিপথ দিয়ে যে রক্তস্রাব হয় তাকে মাসিক বলে। এটি পিরিয়ড, ঋতুস্রাব, রজস্রাব, ঋতুচক্র ইত্যাদি নামেও পরিচিত। মাসিক বা পিরিয়ড হচ্ছে একটি মেয়ের মা হওয়ার সক্ষমতা অর্জন করা। সাধারণত ১২-১৩ বছর বয়স থেকে মাসিক চক্র শুরু হয়।
তবে অনেকের ক্ষেত্রে এর আগেও শুরু হতে পারে। কারণ ভৌগোলিক আবহাওয়া এবং শারীরিক শক্তির ওপর নির্ভর করে মাসিক শুরু হয়। মাসিক শুরু হওয়ার পর নিয়মিতভাবে প্রতি মাসেই হতে থাকে। প্রতি মাসে ৩-৭ দিন পর্যন্ত মাসিক হয়।
যেকোনো নারীর গড় মাসিক চক্র ২৮ দিন। পিরিয়ড বা মাসিকের অনিয়মিত চক্র হিসেব করা হয় ২১ দিনের কম অথবা ৩৫ দিনের বেশি। একটি নির্দিষ্ট বয়সে (৪৫-৫৫) এসে মাসিক চক্র একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। এই অবস্থা কে বলা হয় মেনোপজ। নারীর প্রজনন ক্ষমতার পুরোপুরি নষ্ট হওয়ার ইঙ্গিত দেয় মেনোপজ।
অনিয়মিত মাসিক বা পিরিয়ড নারীদের প্রজনন ক্ষমতার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। ৪০ বছরের কম বয়সী নারীর যদি অনিয়মিত পিরিয়ড হয়, নিঃসন্দেহে এটি চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আবার কোনো নারীর যদি ৭ দিনের বেশি সময় পিরিয়ড হয় সেটিও চিন্তার বিষয়।
পিরিয়ড বন্ধ হয়ে গেলে নারীরা রীতিমতো চিন্তায় পড়ে যায়। মাসিক বন্ধ হলে কি করতে হবে এইটা নিয়ে চিন্তায় পড়ে যায়। কারণ সময়মতো মাসিক হওয়া মানে আপনার হরমোন অথবা শরীরের সবকিছু ঠিকঠাক আছে। তাই মাসিক বন্ধ হওয়া বিষয়ে সচেতন হওয়া খুবই দরকার।
আজকের আর্টিকেলে আলোচনা করা হবে মাসিক বন্ধ হলে কি করতে হবে এই প্রসঙ্গে। এছাড়াও মাসিক বন্ধ হওয়ার কারণ, লক্ষণ ইত্যাদি বিষয়েও আলোচনা করব। সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি মনোযোগ দিয়ে পড়ার চেষ্টা করবেন।
আরও পড়ুনঃ মাসিকের কত দিন পর সহবাস করা যায়
মাসিক বন্ধ বা মেনোপজ

নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য চক্রের জন্য ইস্ট্রোজেন হরমোন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মাসিক বন্ধ হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে ইস্ট্রোজেন নামক হরমোন। ওভারি বা ডিম্বাশয়ে প্রতিমাসে নারীর শরীরে যে ডিম্ব উৎপাদন হয় এবং সন্তান জন্ম দিতে নারীর শরীর যেভাবে প্রস্তুত হয় তার পেছনেও রয়েছে ইস্ট্রোজেনের ভূমিকা।
কারণ এই হরমোন প্রজননের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে নারীর শরীরে ইস্ট্রোজেন হরমোনের উৎপাদন কমে যেতে থাকে। তাই বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে নারীদের ডিম্বাশয়ে ডিম্বের পরিমান কিন্তু কমতে থাকে। সেই সাথে মাসিক বা পিরিয়ডের পরিমাণও কমতে থাকে।
যার ফলে সন্তান জন্ম দেওয়ার প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। সন্তান জন্মদানের প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়া অর্থাৎ মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়াকে বলে মেনোপজ। সাধারণত প্রতিটি নারীর ৪৫ থেকে ৫৫ বছরের মধ্যে মেনোপজ হয়। এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। মাসিক বন্ধ হলে কি করতে হবে তার জন্য জানতে হবে মেনোপজ এর তিনটি ধাপ:
১. পেরি মেনোপজ (মেনোপজ শুরুর ২ থেকে ৩ বছর আগের সময়)
২. মেনোপজ
৩. পোষ্ট মেনোপজ
৪০ বছর বা তার আগে হলে প্রিম্যাচুর মেনোপজ বলে। ৫৫ বছর বা এর পরেও না হলে ডিলেইড মেনোপজ বলে। অর্থাৎ নির্দিষ্ট বয়সে মেনোপজ হওয়ার আগেই যদি পিরিয়ড বন্ধ হয়ে যায় সেক্ষেত্রে একে আর্লি বা প্রিম্যাচুর মেনোপজ বলা হয়।
ডিম্বাশয়ের ক্ষতি করে বা ইস্ট্রোজেন হরমোনের ক্ষতি করে এমন কিছু কারণে আর্লি মেনোপজ হতে পারে। অপ্রাপ্ত বয়সে মেনোপজ হলে বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি হতে পারে। যেমন : হৃদরোগ, বিষণ্নতা, ডিমেনশিয়া, অকাল মৃত্যু ইত্যাদি। এক্ষেত্রে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন।
মাসিক বন্ধ হওয়া বা মেনোপজের কারণ
মাসিক বন্ধ হলে কি করতে হবে তা জানার আগে চলুন জেনে নেই মাসিক বন্ধ হয়ে যায় কেন। বিভিন্ন কারণে মাসিক বন্ধ হতে পারে যেমন :
- ওভারিয়ান ফলিকুলার অ্যাক্টিভিটি কমে গেলে। অর্থাৎ মেনোপজের কয়েক বছর পূর্ব থেকেই ওভারিয়ান ফলিকল কমে যেতে থাকে এবং পিটুইটারি গোনাডোট্রোপিনের প্রতি অসংবেদনশীল হয়ে যেতে থাকে। ওভারি থেকে হরমোন নিঃসরণ করা বন্ধ হলেই হয় মেনোপজ।
- মেনোপজের আরেকটি কারণ হচ্ছে ওভারিয়ান ফেইলিয়র (Ovarian Failure)।
- বাচ্চাকে দুধ পান করানোর সময় (Lactation) ঘন ঘন চক্র ধরে প্রচুর প্রোলাক্টিন নিঃসরণ হয়। যা গোনাডোট্রোপিনের নিঃসরণকে বন্ধ করে ওভারি থেকে স্টেরয়েড হরমোন তৈরি করা বন্ধ করে দিতে পারে।
- গোনাডোট্রোপিন রিলিজিং হরমোন এগোনিস্ট ফাইব্রয়েড বা এন্ড্রোমেট্রিওসিস চিকিৎসা ব্যবহৃত হয়। যা ওভারি থেকে স্টেরয়েড হরমোন নিঃসরণ বন্ধ করে চিরতরে মাসিক বন্ধ করে দিতে পারে।
- অতিরিক্ত ওজন কমে যাওয়া বা ওজন বৃদ্ধি পাওয়ার কারণেও মাসিক বন্ধ হতে পারে।
- এছাড়া থাইরয়েডের সমস্যার জনিত কারণেও মাসিক বন্ধ হতে পারে।
মাসিক বন্ধ হওয়ার লক্ষণ
মেনোপজ প্রতিটি নারীর জন্য একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। একটি নির্দিষ্ট বয়সে এসে প্রতিটি নারী এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায়। এই সময় শরীরে বিভিন্ন ধরনের লক্ষণ দেখা দেয়। মাসিক বন্ধ হলে কি করতে হবে তা জানার জন্য লক্ষণগুলো জানতে হবে :
ভেসোমোটর
- হাত-পায়ে জ্বালা করা।
- রাতের বেলা ঘেমে ওঠা।
- ক্লান্ত লাগা।
- বুক ধরফর করা।
- রাতে ঘুম না হওয়া।
ইউরোজেনিটাল
- প্রস্রাব আটকে রাখতে না পারা।
- প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া হওয়া।
- হাঁচি কাশি হলে প্রস্রাব পড়ে যাওয়া।
- যোনি শুষ্ক হওয়া।
- যোনিপথে রক্তপাত।
- যৌনমিলনে কষ্ট।
- যোনিতে ইনফেকশন হওয়া।
- যৌন চাহিদা কমে যাওয়া।
- যোনিতে চুলকানি।
- সাদাস্রাব হওয়া।
চামড়া ও চুল
- চামড়ার স্থিতিস্থাপকতা কমে যাওয়া।
- সিবাম ও ঘাম নিঃসরণ কমে যাওয়া।
- চামড়ার নিচের ফ্যাট কমে যাওয়া।
মানসিক রোগ
- অস্থির লাগা
- মাথা ব্যাথা
- হতাশ লাগা
- মেজাজ খিটখিটে হওয়া
- ঝিমানি ভাব
হাড়ের সমস্যা
- অস্টিওপরোসিস
- হাড় ভেঙে যাওয়া
- হাড় ব্যথা
হার্টের সমস্যা
- করোনারি হার্ট ডিজিজ
- ইশকেমিক হার্ট ডিজিজ
- স্ট্রোক
মাসিক বন্ধ হওয়া
আমরা ইতিমধ্যেই জেনেছি, মাসিক একেবারে বন্ধ হয়ে যাওয়াকে মেনোপজ বলে। আপনার মেনোপজ হয়েছে কিনা তা নির্ণয় কিভাবে করবেন তা নিচে দেওয়া হল।
- মেনোপজের প্রধান লক্ষণ হচ্ছে ১ বছরেরও বেশি সময় মাসিক বন্ধ থাকে।
- ভেজাইনাল সাইটোলজি – ম্যাচুরেশন ইনডেক্স কমপক্ষে যদি ১০/৮৫/৫ হয়।
- সিরাম ইস্ট্রাডিওল এর পরিমাণ ২০ পিকোগ্রাম / মিলিটারের কম হলে।
- সিরাম এফ এস এইচ ও এল এইচ এর পরিমাণ ৪০ মিলি আই ইউ / মিলিলিটারের কম হলে।
মাসিক বন্ধ হলে করণীয়
মেনোপজ শরীরের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হলেও এই সময় নারীরা বিভিন্ন সমস্যার মধ্য দিয়ে যায়। তাই এ সময় নারীদের বিশেষ যত্ন নিতে হবে। মেনোপজ হলে সাধারণত দুই ধরনের ট্রিটমেন্ট দেওয়া হয়।
১. নন-হরমোনাল ট্রিটমেন্ট
২. হরমোনাল ট্রিটমেন্ট
নন-হরমোনাল ট্রিটমেন্ট
- এই সময় পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে।
- ভিটামিন ডি, ক্যালসিয়াম, ফ্লুওরাইড, থায়াজাইড, ক্যালসিটনিন, বাইফস্ফনেট, ইস্ট্রোজেন রিসেপ্টর মওডুলেটর, ক্লোনিডিন,পেরোক্সেটাইন, গাবাপেন্টাইন ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে।
- যেহেতু একেক জনের শরীর একেক রকম। তাই ওষুধের ক্ষেত্রেও ভিন্নতা থাকবে। সেক্ষেত্রে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ সেবন করতে হবে।
- বিড়ি, সিগারেট বা মদ জাতীয় কোন কিছুর অভ্যাস থাকলে ছেড়ে দিতে হবে।
হরমোনাল ট্রিটমেন্ট
হরমোনাল ট্রিটমেন্ট হচ্ছে HRT অর্থাৎ Hormone Replacement Therapy. হরমোনগুলো হচ্ছে ইস্ট্রোজেন, ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন একসাথে বা ইস্ট্রোজেন ও এন্ড্রোজেন প্রিপারেশন। হরমোনাল ট্রিটমেন্ট সাধারণত তিনটি ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়।
- মেনোপজ এর লক্ষণসমূহ প্রতিকারে।
- অস্টিওপোরোসিস প্রতিরোধ করতে।
- মেনোপজের সময়গুলোতে জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করতে।
শেষকথা
মাসিক বন্ধ হলে কি করতে হবে তা তো জানা হলো। আশা করছি আজকের আর্টিকেলটি আপনাদের ভালো লেগেছে। মাসিক বন্ধ হওয়া বা মেনোপজ হলে চিন্তা না করে নিজের যত্ন নিন। এটি একটি স্বাভাবিক শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া মাত্র। তবে যাদের আর্লি মেনোপজ বা অনিয়মিত মাসিক হয় তাদের জন্য চিন্তার বিষয়।
নিজের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করবেন এবং অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন। মনে রাখবেন অনিয়মিত পিরিয়ড অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অপ্রত্যাশিত খারাপ সংবাদ দিতে পারে। তাই অবশ্যই ডাক্তারের শরণাপন্ন হবেন। পরিশেষে এটাই বলব, প্রত্যেকটি বয়সের একটি নিজস্ব সৌন্দর্য আছে।
প্রত্যেকটি বয়সের আলাদা এই সৌন্দর্যকে মেনে নিয়ে উপভোগ করতে হবে। মাসিক বন্ধ হলে কি করতে হবে এই প্রসঙ্গে যদি আরও কোন প্রশ্ন থাকে অবশ্যই কমেন্ট বক্সে জানাতে ভুলবেন না। আমরা সর্বদা চেষ্টা করব আপনার মূল্যবান প্রশ্নের উত্তর দিতে। সকলের সুস্থতা কামনায় আজকে বিদায় নিচ্ছি।
মাসিক বন্ধ হলে কি করতে হবে সম্পর্কিত প্রশ্ন এবং উত্তর / FAQ’s
১. অবিবাহিত মেয়েদের মাসিক বন্ধ হওয়ার কারণ কি?
উত্তর : অবিবাহিত মেয়েদের মাসিক বন্ধ হওয়ার কারণগুলো হচ্ছে –
- মানসিক চাপ
- স্থূলতা
- হরমোনের ভারসাম্যহীনতা
- জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি
- পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম (PCOS)
- প্রাথমিক ওভারিয়ান ইনসফিসিয়েন্সি (POI)
- এন্ডোমেট্রিওসিস
- খাওয়ার ব্যাধি (অ্যানোরেক্সিয়া বা বুলিমিয়া)
২. আয়রন ট্যাবলেট খেলে কি মাসিক শুরু হয়?
উত্তর : আয়রনের পরিপূরক অর্থাৎ আয়রন ট্যাবলেট শরীরে আয়রনের ঘাটতি বা রক্তস্বল্পতাসহ মহিলাদের মাসিক চক্র উন্নত করতে সাহায্য করে। তবে আয়রন ট্যাবলেট মাসিক প্রবাহের উপর সম্ভাব্য পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও হতে পারে।
৩. তাড়াতাড়ি মাসিক হওয়ার ঘরোয়া উপায় কি?
উত্তর : তাড়াতাড়ি মাসিক হওয়ার কয়েকটি ঘরোয়া উপায় দেওয়া হলো –
- ভিটামিন সি যুক্ত খাবার খাওয়া। যেমন : কমলালেবু, ব্রকলি, টমেটো, লেবু ইত্যাদি।
- প্রতিদিন অন্তত ১০ থেকে ১৫ মিনিট গরম পানিতে পেটে সেঁক দেওয়া।
- যৌনমিলন বা সহবাস মাসিকের শীঘ্রতা আনতে সাহায্য করে।
- আদা চা পান করা।
- চিন্তামুক্ত থাকা।
- পেঁপে অনেক উপকারী ফল হতে পারে মাসিকের শীঘ্রতা আনতে।
৪. ঘন ঘন মাসিক হলে কি করনীয়?
উত্তর : ঘন ঘন মাসিক হওয়া মোটেও স্বাভাবিক বিষয় নয়। এরকম হলে অবশ্যই একজন গাইনোকোলজিস্ট (Gynecologist) দেখাতে হবে।
আরও পড়ুন –
পুরুষাঙ্গের চুলকানি দূর করার ক্রিম ও ব্যবহারবিধি
গালে ব্রণ দূর করার উপায় ও কার্যকরী পদ্ধতি